বরিশালে হঠাৎ করেই চাঙা হয়ে উঠছে মাদক কারবারীরা। পিছিয়ে নেই পুলিশও। প্রায় প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার হচ্ছে মাদক, আটক হচ্ছে কারবারীরা। তবে নিত্য নতুন কৌশল পাল্টে মাদক বেচাকেনার কাজে নারী-শিশুদের ব্যবহার বেড়েছে। কখনো আবার মানবাধিকার কর্মী-সাংবাদিক ও প্রশাসনের সোর্স পরিচয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা। নগরীর সর্বত্রই হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। ফলে কিশোর-যুবকরা মাদকের ভয়াল ছোবলে পড়ে তাদের ঠাঁই হচ্ছে মাদক নিরাময় কেন্দ্র কিংবা কারাগারে। কেউবা আবার নেশায় বুদ হয়ে পিতা-মাতার উপর করছে হামলা, কখনো বা নিজেই চেষ্টা করছে আত্মহত্যার। ঘটছে মৃত্যু।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিনই মাদক উদ্ধার হওয়ায় সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা। তবে আতঙ্কিত না হয়ে সন্তানদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ এবং মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেলের তথ্য মতে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত নগর গোয়েন্দা (ডিবি) ও থানা পুলিশের অভিযানে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬০ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে ৪৫ কেজি ৫৯৫ গ্রাম গাঁজা ও ২ হাজার ৩৮৩ পিস ইয়াবা। আটককৃতদের মধ্যে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশের অভিযানেই আটক হয়েছে ২৩ জন মাদক ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কাউনিয়া থানা পুলিশের অভিযানে শুধুমাত্র মে-জুন মাসেই আটক হয়েছে ১৬ জন মাদক কারবারী।
জানা গেছে, মাদক বহনে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে ব্যবসায়ীরা। নিজেরা চিহ্নিত হওয়ার কারণে স্ত্রী-সন্তানদেরও ব্যবহার করছে। আর মাদক বহনের কাজে অ্যাম্বুলেন্সে এমনকি লাশের কফিনও ব্যবহার করছে তারা। এছাড়া সবজির ট্রাক, মাছের ঝুড়ি, চিঠির খাম, জুতার সোল, স্কুল ব্যাগে করেও মাদক পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মাদকের স্পটে। মাদক ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে পছন্দ কুরিয়ার সার্ভিস, যার মাধ্যমে মাদক নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া হয় মাদকসেবীদের কাছে। এছাড়া বিকাশ করলেই মুঠোফোনে জানিয়ে দেওয়া হয় মাদকের ঠিকানা।
বিভিন্ন সূত্রের দেয়া তথ্য মতে, চিহ্নিত এলাকাগুলোতে পুলিশের তৎপরতার কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টানোর সাথে নতুন নতুন এলাকা বেছে নিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, কাউনিয়া থানাধীন ভাটিখানা, রসুলপুর কলোনি, বিসিক, মতাসার, পশ্চিম কাউনিয়া হাওলাদার সড়ক, হাজের খাতুন স্কুল সড়ক, ড্রেন সড়ক, বিসিক খালপাড়, কমিশনার গলি, আরজু মনি স্কুল সংলগ্ন এলাকা, বাসু মিয়ার গলি, আমানতগঞ্জ, আমিরগঞ্জ বাজার, কাউনিয়া বরফকল এলাকা, কাশিপুর বিল্ববাড়ি, নিলখোলার পাড়, চরবাড়িয়া, শায়েস্তাবাদ, পলাশপুর ও বাঁশের হাট খোলা।
এয়ারপোর্ট থানাধীন গনপাড়া, লাকুটিয়া, বকশিরচর মোল্লার বাড়ি এলাকা, চন্ডিপুর ভাড়ানিকান্দা জাকির মেম্বারের বাড়ি এলাকা, রুইয়ার পোল, সোনামিয়ার পোল, বারৈজ্জারহাট, কাশিপুর, কুদঘাটা, দিয়াপাড়া, ইছাকাঠী, মাদবপাশা, নতুন হাট, মোহনগঞ্জ, সারশি ও জাম্বুরাতলা।
কোতয়ালী থানাধীন গোড়া চাঁদ রোড, কলেজ এভিনিউ, গোরস্থানরোড, ফকির বাড়ী রোড, কালিবাড়ী রোড, সাগরদি ধানগবেষণা সড়ক, লালাদিঘির পাড়, রূপাতলী আহম্মেদিয়া মোল্লা সড়ক, বসুন্ধরা হাউজিং, চাঁদমারী স্টেডিয়াম বস্তি, কেডিসি বস্তি, রিফুজি কলোনী, কালুশাহ সড়ক, পরেশ সাগর মাঠ, সোনারগাও টেক্সটাইল এলাকা, নতুনবাজার বস্তি, বৈদ্যপাড়া ও জিয়া সড়ক।
এছাড়া বন্দর থানাধীন বিশ^বিদ্যালয় এলাকা, চরকাউয়া এলাকায়ও মাদক বিক্রি হচ্ছে।
ওই সব এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা তৈরি করছে নতুন নতুন মাদকসেবী। বিশেষ করে উঠতী বয়সী যুবকরা জড়িয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। আর নেশার টাকা জোগাড় করতে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এমনকি নেশার টাকা না পেয়ে নিজেই আত্মঘাতী হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৩ জুন বিকেলে বরিশাল নগরীর বিএম স্কুল রোডে সদ্য এসএসসি পাশ করা মো. রাফি নামের এক কিশোর নিজের বুকে ছুরি চালিয়েছে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। বরিশালের মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, নগরীর চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর পরিবারের সন্তানরাও মাদকে আসক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেখা যায়, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাচ্ছে। কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে ফের জড়াচ্ছে মাদক ব্যবসায়। তাই মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়ে সচেতন নগরবাসী বলছেন, এখনই মাদকের আধিক্য বন্ধ না করা গেলে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে শত শত যুবসমাজের জীবন।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশালের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা শাহ্ সাজেদা বলেন, মাদকের বিস্তাররোধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সকলকে সচেতন হতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের কৌশল পাল্টানোর বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশকেও তাদের অভিযানের কৌশল পাল্টাতে হবে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. লোকমান হোসেন বলেন, মাদক নির্মূলে সকলকে সচেতন হতে হবে। শুধুমাত্র প্রশাসনের উপর নির্ভর না থেকে স্থানীয়ভাবে মাদক নির্মূলে উদ্যোগ গ্রহণ করার কথাও বলেন তিনি।
বিএমপি কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, শুধুমাত্র মাদক-ই নয় অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে থানার বিভিন্ন এলাকা, স্থানীয় স্কুল-কলেজে নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (সিএসবি এন্ড ডিবি) অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার পিপিএম সেবা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও স্থানীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সাড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। তবে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করতে হলে সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের একার পক্ষে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।