আধুনিক বিশ্বে মানবাধিকার একটি বহুল আলেচিত বিষয়। মানবাধিকার বলতে সরলার্থে মানুষের অধিকার বোঝায়। যেসব মানবিক অধিকার ব্যতীত মানুষ পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে মানবিক মর্যাদাসহ জীবনধারণ করতে পারে না এবং মানবিক স্বাভাবিক গুণাবলী ও বৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না, সাধারণভাবে সে সবই মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত।
এ অধিকারসমূহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক এ তিনভাবে বিভক্ত। অর্থনৈতিকভাবে ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, জীবিকার্জন, সম্পত্তির মালিকানা লাভ ও তা সংরক্ষণের অধিকার অর্থাৎ জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও নিজের যোগ্যতানুযায়ী কর্মসংস্থানের অবাধ অধিকার ইত্যাদি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে গণ্য।
সামাজিকভাবে মানবাধিকার বলতে বোঝায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ, গোত্র-লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে সম অধিকার, মতামত প্রকাশ, জানমালের নিরাপত্তা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, রাজনৈতিক তথা নাগরিক অধিকার, সভা-সমিতি-সংগঠন ও জনমত গঠনের অধিকার অবাধে নিজ ধর্ম-কর্ম করার অধিকার, আইনের শাসন ও বিচার লাভের অধিকার, বিবাহ-তালাক ইত্যাদি বিষয় মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
নৈতিকভাবে মানবাধিকার বলতে বুঝায় অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা, শ্লীলতার প্রসার ও অশ্লীলতা প্রতিরোধ, সৎকর্মের প্রসার ও অসৎ কর্মের প্রতিরোধ, পিতা-মাতা ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি আদর-স্নেহ-যতœ প্রদর্শন ও তাদের প্রতিপালন, যথাযথ লালন-পালন, সমাজের দরিদ্র অসহায়, বিধবা, ইয়াতীম, অধিকার বঞ্চিত, মজলুম মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন, মেহমান-মুসাফিরদের আপ্যায়ন, সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি শালীনতা ও সৌজন্যমূলক আচরণ ইত্যাদি নৈতিক অধিকারের শামিল।
জাতিসংঘ ও মানবাধিকার ঃ
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ সনের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ৩০ ধারা সংবলিত মহাসনদ ঘোষণা করে। জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রের জন্য এ সনদ অনুসরণ বাধ্যতামূলক করেনি। জাতিসংঘ চায় তার সদস্য-রাষ্ট্রসমূহ যথাসাধ্য এটা অনুসরণ করুক। কোনো দেশ মানবাধিকারের ঘোষিত সনদ কতটা অনুসরণ করছে অথবা লংঘন করছে তা পর্যবেক্ষণ করা ও এ সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘ একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করেছে। বিভিন্ন দেশে এ কমিশনের শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তার মাধ্যমে সদস্য-রাষ্ট্রসমূহে মানবাধিকার সম্পর্কিত অবস্থার যাবতীয় রিপোর্ট জাতিসংঘ তথা বিশ্ববাসী যথাসময়ে অবগত হতে পারে।
জীবন ধারণের অধিকার ঃ
জীবনের নিরাপত্তা তথা স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার এবং নিরাপদ জীবন যাপন সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছেÑ
ولا تـقـتـلـوا الـنـفـس الـتـى حـرم الـلـه الا بـالـحـق ـ
“আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না।” সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৩)
সম্পদের অধিকার ঃ
ইসলাম সকল মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের তাগিদ দিয়েছে। আল্লাহ বলেনÑ
ولا تـأكـلـوا امـوالـكـم بـيـنـكـم بـالـبـاطـل ـ
“তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।” (সূরা বাকারা : ১৮৮)
রাসূলে করীম (সা.) তাঁর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, ‘তোমাদের জীবন ও সম্পত্তি তোমাদের পরস্পরের নিকট পবিত্র।’ সম্পদের অধিকার রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেনÑ
مـن قـتـل دون مـالـه فـهـو شـهـيـد ـ
‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ।’ (বুখারী)
ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার ঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং স্বাধীনতা আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার। যে কোন ধরণের জোর-জবরদস্তি ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামী নীতি অনুযায়ী কোন উপযুক্ত আদালতে আইনানুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কোনরূপ শাস্তি দেয়া যাবে না। আইনের সুস্পষ্ট বিধান ছাড়া কাউকে গ্রেফতার, আটক বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। ইমাম মালিক (র.) বলেন, ‘বিনা বিচারে শাস্তি প্রদান ইসলাম অনুমোদন করে না।’
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার ঃ
ইসলাম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়। এ ব্যাপারে আল কুরআনের নির্দেশÑ
يـايـهـا الـذيـن امـنـوا لا تـدخـلـوا بـيـوتـا غـيـر بـيـوتـكـم حـتـى تـسـتـانـسـوا و تـسـلـمـوا ـ
‘হে ঈমানদারগণ ! তোমরা নিজেদের বাড়ি ছাড়া অন্যের বাড়িতে মালিকের অনুমতি না নিয়ে, সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না।’ (সূরা আন-নূর : ২৭)
বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা ঃ
ইসলামী রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের বিবেক ও ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছে। আল কুরআনের ঘোষণাÑ
لا اكـراه فـى الـديـن قـد تـبـيـن الـرشـد مـن الـغـى ـ
‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা।’ (সূরা বাকারা : ২৫৬)
আর্থিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার ঃ
ইসলাম ধর্ম-বর্ণ গোত্রের বিভিন্নতার জন্য কাউকে তার মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদা যেমন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে না। চাকরি ও জীবিকার্জনের জন্য রয়েছে সকলের সমান সুবিধা। তাছাড়া, বেকার, ইয়াতীম এবং শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ-সাহায্য করার বিধান রয়েছে। হযরত উমর (রা.) জাতীয় সম্পদ বন্টন প্রসঙ্গে নিজের জিম্মাদারীর ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে বলেনÑ ‘আল্লাহর শপথ ! আমার খেলাফতকালে সানআর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত মেষ বালকও স্বস্থানে বসে তার অংশ পেয়ে যাবে তার চেহারায় বিষণœতার ছাপ পড়ার আগেই।’ (কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২১২)। হযরত উমর (রা.)-এর আরো ঘোষণা : ‘ফোরাতের কূলে একটি কুকুরও না খেয়ে মারা গেলে কাল কিয়ামতের ময়দানে সে জন্য উমরকেই দোষারোপ করা হতে পারে।’
বসবাস, যাতায়াত ও স্থানান্তরের অধিকার ঃ
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তার পছন্দমাফিক যে কোন স্থানে বসবাস করার, রাষ্ট্রীয় সীমানার ভিতরে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের বাইরে যে কোন অঞ্চলে যাতায়াত করার স্বাধীনতা ভোগ করে। নাগরিকদের ইচ্ছা মাফিক বাসস্থান ত্যাগ ও স্থানান্তরের স্বাধীনতা দিয়েছে ইসলাম।
গণতান্ত্রিক অধিকার ঃ
মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার, ন্যায়সঙ্গতভাবে সরকারের সমালোচনা করার অধিকার ইসলামে স্বীকৃত।
পারিশ্রমিক লাভের অধিকার ঃ
ইসলাম শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত সকল অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে বিনা পারিশ্রমিকে অথবা কম মজুরীতে কারো শ্রম নেয়া অবৈধ। মজুরের আর্থিক কিংবা দৈহিক যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া, সামর্থ্যরে বাইরে কারো ওপর কাজের বোঝা না চাপানো, মজুরের সাথে সাধারণ মানবিক আচরণ করা, শ্রমিককে ত্বরিৎ তার মজুরী পরিশোধ করার তাগিদ দিয়েছে। নবী করীম (সা.) বলেছেনÑ “শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার মজুরী দিয়ে দাও।” (বায়হাকী, ইবনে মাজাহ)
নারীর অধিকার ঃ
নারীদের অধিকারের ব্যাপারে ইসলামই সর্বপ্রথম বাস্তব ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি দ্বারা নারীর যথাযথ অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে প্রথম শ্রেণীর উত্তরাধিকার-কুরআনী অংশীদারের ১২ জনের মধ্যে ৮ জন মহিলা। অথচ ইসলাম-পূর্ব যুগে তাদের কোন উত্তরাধিকারিত্ব ছিল না। হিন্দুধর্মসহ পৃথিবীর বহু ধর্মের নারীর উত্তরাধিকারিত্ব স্বীকার করা হয়নি। স্ত্রীর প্রতি আচরণ সম্পর্কে পুরুষের উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআন ঘোষণা করেছেÑ
اسـكـنـوهـن مـن حـيـث سـكـنـتـم مـن وجـدكـم ولا تـضـاروهـن لـتـضـيـقـوا عـلـيـهـن ـ
‘তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেরূপ গৃহে বাস কর, তাদেরকেও বসবাসের জন্য সেরূপ গৃহ দাও। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সংকটাপন্ন করো না।’ (সূরা আত্ ত্বালাক : ৬)
সংখ্যালঘুদের অধিকার ঃ
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার অধিকার দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেনÑ “অমুসলিমদের জীবন আমাদের জীবনের এবং তাদের সম্পদ আমাদের সম্পদের মতই।” তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকার ইসলাম স্বীকার করে। মদীনা সনদ অমুসলিমদের মদীনায় বসবাসের অধিকার দিয়েছিল। এমনকি, তাদের একটি অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করা সত্ত্বেও বাকী অংশের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়নি। ইসলাম একজন অমুসলিম শ্রমিককে একজন মুসলিম শ্রমিকের মতই সুযোগ-সুবিধা দেয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, “সতর্ক থাক, সে ব্যক্তি সম্পর্কে যে ব্যক্তি অমুসলিমদের উপর যুলুম করে অথবা তাদের হক নষ্ট করে অথবা তাদের সামর্থ্যরে চেয়ে বেশী কাজের বোঝা চাপাতে চেষ্টা করে অথবা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের থেকে কিছু জোরপূর্বক নেয়, আমি কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ব।” (আবু দাউদ)
আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও দাস-প্রথার উচ্ছেদ ঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান এবং পৃথিবীর ‘সকল মানুষ একই সম্প্রদায়ভুক্ত’, আল কুরআনের ভাষায়Ñ
ولا تـسـبـوا الـذيـن يـدعـون مـن دون الـلـه ـ
“আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য দেব-দেবীর উপাসনা যারা করে তাদের উপাস্যদের তোমরা গালি দিয়ো না।” (সূরা আনআম : ১০৮)
ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান এবং পৃথিবীর ‘সকল মানুষ একই সম্প্রদায়ভুক্ত’, আল কুরআনের ভাষায় :
كـان الـنـاس امـة واحـدة ـ
‘সমগ্র মানব জাতি একই উম্মাহভুক্ত।’
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ঃ
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উৎপাদিত পণ্যে শ্রমিকের অংশীদারিত্বের কথা বলেছেন। দুনিয়ার কোথাও যখন শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে মানুষের কোনই সচেতনা ছিল না সেই অন্ধকার যুগে বিশ্ব-মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদীনার নগর রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইসলামী সমাজে নারী, পুরুষ, শ্রমিক, সাধারণ জনতা নির্বিশেষে সকল মানুষ মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণরূপে ভোগ করে। আধুনিক মানবাধিকারের ধারণা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে ১৯৪৫ সালে প্রণীত জাতিসংঘ চার্টারে। কিন্তু এর ১৩০০ বছর পূর্বে সমগ্র পৃথিবী যখন জাহিলিয়াতের ঘনান্ধকারে নিমজ্জিত, সে সময় মহানবী (সা.) মানবাধিকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করে মানুষের ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আদর্শ মানব সমাজ গঠনে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহর নবী (সা.) নিজেও শ্রমিক ছিলেন।
ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তির স্থান নেই ঃ
মহানবী (সা.) ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছেন। মহানবী (সা.) বলতেন, “যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে, সে কোনদিন ভিক্ষা করবে না তার জান্নাত লাভের দায়িত্ব আমি নিলাম।” (আবু দাউদ)
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ঃ
আমাদের শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হচ্ছে প্রভু-ভৃত্যের সমতুল্য। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর আদর্শে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা সকলেই আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে রাসূল করীম (সা.) বলেছেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন, তাকে তাই খাওয়াতে হবেÑ যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরতে দিতে হবে যা সে নিজে পরিধান করে।” (বুখারী-মুসলিম)
শ্রমিকের প্রতিও আল-কুরআনের নির্দেশÑ
ان خـيـر مـن اسـتـأجـرت الـقـوى الامـيـن ـ
‘সর্বোত্তম শ্রমিক সে যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সমর্থ ও আমানতদার।’ (সূরা কাসাস: ২৬)
ইসলামে শিশুশ্রম ঃ
ইসলাম শিশুশ্রম সমর্থন করে না। ছোটদের প্রতি দয়া, তাদের শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা ইসলাম জাতীয় ও ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করে। মহানবী (সা.) বলেছেনÑ “যারা ছোটদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না এবং বড়দেরকে সম্মান করে না তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (আবু দাউদ)
মজুরি নির্ধারণ ঃ
নবী করীম (সা.) “মজুরি নির্ধারণ ব্যতীত কোন শ্রমিককে কাজে নিযোগ করা অনুচিত।” (বায়হাকী) ইসলাম যে কোনো লেনদেনের চুক্তি লিখিতভাবে করার নির্দেশ দিয়েছে। কোনো শ্রমিকের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ করানো হলে অবশ্যই তাকে অতিরিক্ত মজুরি দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশÑ “তোমরা তাদের উপর বাড়তি দায়িত্ব চাপালে সে হিসাবে তাদেরকে বাড়তি মজুরি দিয়ে দাও।”
রাসূলে পাক (সা.) পারিশ্রমিক নির্ধারণ ছাড়া শ্রমিকদের থেকে কাজ করিয়ে নেয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক কাজ করা মাত্রই পারিশ্রমিক দাবী করতে পারে। চুক্তি অনুসারে প্রত্যেক শ্রমিককে যথাসময়ে পূর্ণ বেতন পরিশোধ করে দিতে হবে। ত্বরিত মজুরি পরিশোধের তাগিদ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেনÑ “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার মজুরি আদায় করে দাও।” (ইবনে মাজাহ)
পরিশেষে উল্লেখিত মৌলিক মানবাধিকারের পাশাপাশি ওআইসির ফিকহ একাডেমী ঘোষিত দলিলটি একটি ঐতিহাসিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। যার ১ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে- “All Human beings form one family whose members are united by submission to God and descent from Adam. All men are equal in terms of basic human dignity and basic obligations and responsibilities, without any discrimination on the grounds of race, color, language, sex, religious belief, political affiliation, social status or other considerations. True faith is the guarantee for enhancing such dignity along the path to human perfection.”
অর্থাৎ আদম থেকে উদ্ভূত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ সমগ্র মানবজাতি এক পরিবারের সদস্য। জাতি, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, নারী-পুরুষ, ধর্ম বিশ্বাস, রাজনৈতিক মতবাদ, সামাজিক অবস্থান বা অন্য যে কোন বিবেচনা নির্বিশেষে মূল মানবিক মর্যাদা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিক থেকে সকল মানুষ সমান। খাঁটি ঈমান ব্যক্তির মধ্যে মানবিক পূর্ণতা এনে দিয়ে এ মর্যাদা বৃদ্ধিকে গ্যারান্টি দেয়।
মুসলিম বিশ্বের জন্য এ ডকুমেন্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় এ দলিলটি যতটা প্রচার হওয়ার দরকার ছিল মুসলিম বিশ্ব সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতের জন্য এটি ব্যাপকভাবে প্রচার হবে। ইসলামের আলোকে সর্বসম্মত মানবাধিকার ঘোষণার এ অত্যন্ত মূল্যবান দলিলের মাধ্যমে আমাদের জাতি-সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ খান
ইনচার্জ, নিবরাস ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা, মোহাম্মদপুর ক্যাম্পাস।