বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশ আজ, আসছেন নেতাকর্মীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: শনিবার ৫ই নভেম্বর ২০২২ ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন
বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশ আজ, আসছেন নেতাকর্মীরা

বরিশালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ আজ। সমাবেশ ঘিরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে বরিশাল নগরীসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল। সমাবেশের দুই দিন আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন ও লঞ্চ চলাচল। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার সঙ্গে সারাদেশের সড়ক ও নৌপথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সব শেষ আজ শনিবার ভোর থেকে বরিশালের খেয়া নৌকায় যাত্রী পারাপারও বন্ধ থাকবে। এর আগে গতকাল মধ্য রাতে বন্ধ করে দেয়া হয় ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস। যে কারণে সারাদেশ থেকে এখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে বিভাগীয় শহর বরিশাল। ফলে পথে পথে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এদিকে সমাবেশে অংশ নিতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়েছেন বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী। এ কারণে বৃহস্পতিবার রাত থেকে নেতাকর্মীদের ঢল নেমেছে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে।



নিত্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন স্থানে গুলিতে দলের নেতাকর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদসহ দলীয় চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করছে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় আজ শনিবার বরিশাল বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া দলের কেন্দ্রীয় নেতারা গণসমাবেশে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।


সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার থেকেই বরিশালে বাস, লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। তবে সমাবেশে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা বরিশালে এসে জড়ো হয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকালেই ভরে গেছে সমাবেশস্থল।


গতকাল শুক্রবার সকালে সরজমিনে নগরীর রূপাতলী, নথুল্লাবাদ বাস র্টামিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল ও খেয়াঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ছয়টার পর বরিশাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি এবং অন্য কোনো বিভাগ থেকে বরিশালেও আসেনি। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। বাস না পেয়ে অনেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। পরিবহন বন্ধ থাকায় মালামাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও।


বরিশাল বাসস্ট্যান্ডে বাসের টিকেট কাউন্টারগুলো বন্ধ। স্ট্যান্ডে সব বাস সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া অভ্যন্তরীণ সব রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ায় যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে। সকাল থেকে যাত্রীরা নদী বন্দরে এসে ফিরে যাচ্ছেন। মনির হোসেন নামে মেহেন্দিগঞ্জের এক বাসিন্দা বলেন, ডাক্তার দেখাতে বরিশালে এসেছিলেন বৃহস্পতিবার সকালে। রাত হয়ে যাওয়ায় আর ফিরতে পারিনি। আজ সকালে ঘাটে এসে দেখছি লঞ্চ চলাচল বন্ধ। এখন বাধ্য হয়ে বরিশালের থাকতে হবে।



পরিবহন বন্ধের জন্য সরকারকে দায়ী করে বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, গণসমাবেশের যেন মানুষ আসতে না পারে সেজন্য সরকার এমন কাজ করেছে। তবে সরকার সংশ্লিষ্টদের দাবি, এতে সরকারের কোনো হাত নেই।


বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ বলেন, রাতে উদ্যানেই ঘুমান দূর থেকে আসা নেতাকর্মীরা। কারণ আবাসিক হোটেলগুলোতে পুলিশ অভিযানের নামে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকার আমাদের সমাবেশ ঠেকাতে চায়। তবে তাদের কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। জনগণের জন্য আন্দোলনে সব বাধা অতিক্রম করে দুই দিন আগেই সমাবেশস্থলে হা?জির হয়েছেন নেতাকর্মীরা। এখানেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে ত্রিপল টা?নিয়ে। খাবারের জন্য রান্না করা হচ্ছে। নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলেই বৃহস্পতিবার থেকে নামাজ আদায় করেছেন এবং জুম্মার নামাজও আদায় করেছেন।


ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর মাইনকা ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মহসিন সিকদার বলেন, অসম্ভব দুর্ভোগ-দুর্দশা সহ্য করে বৃহস্পতিবার রাতে নেতাকর্মীদের নিয়ে সমাবেশস্থলে এসেছি। আমরা ট্রলার ভাড়া করে কয়েক হাজার মানুষ এসেছি। এত কষ্ট করছি শুধু ভোটাধিকার ফেরত পাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ১৫ বছর ধরে ভোট দিতে পারি না। অথচ দেশ স্বাধীন হয়েছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।


যুবদল নেতা মনির আকন বলেন, একাধিকবার হামলা ও মামলার স্বীকার হয়েছি, কষ্ট করছি, আরো করব। কিন্তু ভোট না দিয়ে মেম্বার, চেয়ারম্যান ও এমপি নির্বাচনের খেলা আর দেখতে চাই না। পাথরঘাটার বিএনপিকর্মী সাইদুল ইসলাম বলেন, সরকারের নির্দেশে আমাদের সমাবেশস্থলটি বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে, লাভ হয়নি। ভোটাধিকার ফেরত পেতে আমরা চলে এসেছি। বিনাভোটের জনপ্রতিনিধি আর দেখতে চাই না। জেলা উত্তর বিএনপির সিনিয়র সদস্য এস এম মনির-উজ জামান মনির বলেন, সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে এই সরকারের পতন ঘটবে। এজন্য দুই দিন আগেই সমাবেশস্থল পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।


স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থায় নেতাকর্মীরা সমাবেশে আসার সময় সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের বাধা সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু যত বাধাই আসুক, বরিশাল বিভাগের কয়েক লাখ মানুষ গণসমাবেশে উপস্থিত হবেন। গণসমাবেশে যে জনস্রোত হবে তা কোন কিছুর বিনিময়েই আটকানো যাবে না।


সমাবেশের মাঠেই দুটি জামাতে জুমার নামাজ আদায়: সমাবেশে অংশ নেয়া নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু উদ্যান (বেলস পার্ক) মাঠেই পৃথক দুটি প্যান্ডেলে জুমার নামাজ আদায় করেছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে একসঙ্গে হাজারো নেতাকর্মীদের অংশ নিতে দেখা যায় জুমার নামাজে। নেতাকর্মীদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন নামাজ পরিচালনা করেন। এছাড়া সমাবেশস্থলে যোগ দেয়া নেতাকর্মীরা প্রখর রোদ উপেক্ষা করতে মাঠের চারপাশে গাছতলা, তাবুর নিচে আশ্রয় নিয়েছেন।


বন্ধ মাইক্রোবাস: গতকাল থেকে আজ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই দিন বরিশাল জেলায় ভাড়ায়চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে জেলা ট্যাক্সি ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন। গতকাল রাতে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নুরুজ্জামান জলিল বলেন, ৪-৫ নভেম্বর আমাদের তেমন কোনো ট্রিপ হবে না। এজন্য আমরা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে জরুরি সেবা যেমন কেউ অসুস্থ হলে তাদের সেবা দেয়া হবে।


তিনি বলেন, বরিশাল নগরীতে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি থাকায় মাইক্রোবাস চালকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, যদি হামলা হয় তাহলে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এই ক্ষতির মুখে যেন না পরতে হয় সেজন্যই আপাতত না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।


সবশেষে বন্ধ হলো খেয়া নৌকা: বাস-লঞ্চ, মাইক্রোবাস এবং থ্রি হুইলার দুই দিন বন্ধ ঘোষণার পর এবার বরিশালের বিভিন্ন স্থানের খেয়া নৌকা চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গতকাল ভোর থেকে নগরীর চরকাউয়া খেয়া এবং কাটাদিয়া খেয়া চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতিনিয়ত দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এসব খেয়া নৌকায় চলাচল করেন হাজার হাজার মানুষ। আকস্মিক খেয়া বন্ধ হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। রোগী পরিবহনও রয়েছে বন্ধ।


বঙ্গবন্ধু উদ্যান যেন পিকনিক স্পট: নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে যেন পিকনিক চলছে। বড় বড় হাঁড়িতে বসানো হয়েছে রান্না। মাঠের মধ্যে তাবু টানিয়ে চলছে আড্ডা ও স্লোগান। মধ্যরাতের পর ওই তাবুর নিচেই ঘুমিয়ে রাত্রিযাপন করছেন বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী। গত বৃহস্পতিবার ও গত রাতে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশস্থলে। বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, বিভাগীয় সমাবেশ সফল করতে আসা নেতাকর্মীদের বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপরও বরিশালের গণসমাবেশে জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। প্রয়োজনে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে, বাই সাইকেলে, ট্রলার ও নৌকায় চেপে আসবেন।


রাতেই ভরে গেছে উদ্যান: সমাবেশের একদিন আগে গতকাল রাতে বরিশালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের ভেন্যু বঙ্গবন্ধু উদ্যানে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী।


নেতাকর্মীদের সমাগমে মুখরিত সমাবেশস্থল। কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বরিশালের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে ভিড় করেছেন।


গতকাল ভোরে ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে বরিশালে এসে পৌঁছেছেন আরো কয়েক হাজার নেতাকর্মী। তারা বলছেন, ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের বাধা ও পুলিশি হয়রানি। এ কারণে আগেভাগে তারা বরিশালে এসে অবস্থান নিয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, জনগণের এমন ভোগান্তির জবাব ?জনগণই দেবেন।


সব পথেই বরিশাল ঢোকা বন্ধ : গণসমাবেশের আগের দিন গতকাল ভোর থেকে সব পথেই বরিশালে ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া নগরীর মধ্যে কেবল হাতে গোনা কিছু রিকশা চলাচল করেছে। সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে রিকশা শ্রমিক নেতারা ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে বাধাও দিয়েছেন। এ অবস্থায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। প্রয়োজনে বরিশাল ছাড়তে পারছেন না কেউ, আবার প্রবেশ করাও যাচ্ছে না। সার্বিক পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মোড়ে মোড়ে তল্লাশি করছে পুলিশ।


একই মাঠে বিএনপি-প্রশাসনের পৃথক দুটি মঞ্চ: ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিএনপি ও প্রশাসনের পৃথক দুটি মঞ্চ তৈরি ও প্যান্ডেল সাজানোর হয়েছে। উদ্যানের পূর্বপ্রান্তে স্থায়ী মঞ্চ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। এর বেশ খানিকটা দূরে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশের মঞ্চ। গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে। যেখানে প্যান্ডেল করা হচ্ছে সেখানে দায়িত্বশীল কেউ নেই। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাঠে আগামী ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তাই বালু ফেলে মাঠ ঠিক করা হচ্ছে। বাঁশ দিয়ে প্যান্ডেলের কাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।


জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, আগামী ৭ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ১০০ সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে বরিশালের ১৬টি সেতু রয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন বরিশালের রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাই বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মূলমঞ্চ ঘিরে চলছে প্রস্তুতি।