
প্রকাশ: ৪ নভেম্বর ২০১৯, ২২:২৪

চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো, আপনি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও নামাজ রোজা রাখতে পারছেন না, কোরআন ও অন্যান্য ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন না, নারীরা হিজাব চাইলেও ব্যবহার করতে পারছেন না, এমনকি সরকারি চাকরিতে হিজাবি নারীদের নিয়োগ পথ বন্ধ; এক কথায় ধর্মীয় স্বাধীনতার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সরকারিভাবে। তখন আপনি কি করবেন? এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আপনারা হয়তো ভাবছেন, এমন কোন সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্ব কী বর্তমান পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে! অথচ এমনি ঘটনা দীর্ঘ ৭০ বছর যাবত প্রত্যক্ষ করে আসছে চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়, চীন সরকারের নির্মম নির্যাতন এবং নৃশংশতার সাক্ষী শিনজিয়াং প্রদেশের ১ কোটি ১০ লাখ মুসলমান।
শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেয়ার জন্য চীনের অন্য অঞ্চল থেকে মূল চীনাদের এখানে এনে পুনর্বাসন করা হয়। ফলে ১৯৪৯ সালে শিনজিয়াং এ যেখানে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৯৫%, ১৯৮০ সালের মধ্যেই তা ৫৫% এ নেমে আসে। ১৯৮৮ সালে চীনাদের এই দমন পীড়নের হতে মুক্তি লাভ ও চীনের থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য উইঘুররা প্রতিষ্ঠা করেন – পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা কিছু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চীনা সরকার ১৯৯০ সালে সেখানে পরিকল্পিত ভাবে এক দাঙ্গা পরিচালনা করে। পরে এই দাঙ্গার অভিযোগেই হাজার হাজার উইঘুর যুবককে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং কারাদণ্ড প্রদান করে চীন সরকার।

উইঘুর তথা মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার তার কোন কিছুই বাকি রাখছে না চীনা প্রশাসন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতির মাধ্যমে সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছে। তা হুবুহু তুলে ধরছি, 'উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরের দরজায় লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ কোড, বসানো হয়েছে মুখ দেখে সনাক্ত করা যায় এরকম ক্যামেরা। ফলে কোন বাড়িতে কারা যাচ্ছেন, থাকছেন বা বের হচ্ছেন তার উপর কর্তৃপক্ষ সতর্ক নজর রাখতে পারছে। তাদেরকে নানা ধরনের বায়োমেট্রিক পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে।'
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটি ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে চীনের ‘সন্ত্রাসবাদ’ কেন্দ্রগুলোয় আটক রাখা হয়েছে। ২০ লাখ মানুষকে ‘রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনার শিবিরে’ অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়েছে। এসব তথ্যের সাথে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগের মিল পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, যেসব লোকজনের ২৬টি তথাকথিত 'স্পর্শকাতর দেশের' আত্মীয়-স্বজন আছেন তাদেরকে এসব ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান এবং তুরস্কসহ আরো কিছু দেশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এছাড়াও যারা মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেছে তাদেরকে টার্গেট করেছে কর্তৃপক্ষ।


শিনজিয়াং প্রদেশে সংবাদ মাধ্যম নিষিদ্ধ। তাই এসব অত্যাচারের নির্মমতা মানুষ খুব কমই জানতে পারছে। চীন সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত নীতির ব্যাপারে চীন বলে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থার মোকাবিলা করার জন্যই তারা নানান পলিসি নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু দাড়ি রাখা, রমজান মাসে রোজা রাখা কীভাবে ধর্মীয় চরমপন্থা, তা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পারে না। মূলত ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের মতে চরমপন্থা। আর এই চরমপন্থা দমনের নামে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা চলছে। অপরদিকে গোটা বিশ্ব বিবেক এই বর্বর নির্যাতন চেয়ে চেয়ে দেখছে। মাঝেমধ্যে নিন্দা করে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কোনো দেশ এই ব্যাপারে তেমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা নিতে পারছেন না। তবে সকল উদারবাদী শান্তিপ্রিয় মানুষের একটাই চাওয়া, অচিরেই উইঘুর মুসলিমরা যেন চীনে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ফিরে পায়।
লেখক, হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব