দক্ষিণ-পূর্বদিকে তেঁতুলিয়া, উত্তর-পশ্চিমে বুড়াগৌরাঙ্গ নদী। এর মাঝখানে অবস্থিত ‘চরনজির’। যে চরের যাতায়াত শুধুই নৌপথ নির্ভর, বিকল্প আর কোন ব্যবস্থা নেই। তাই চরের বাসিন্দাদের যেখানেই যেতে হোক- পাড়ি দিতে হবে নৌপথ। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের আওতাধীন দুর্গম এ চরের অবস্থান।
যে চরে জনবসতি আছে, কিন্তু তাদের জন্য নেই নাগরিক সুবিধা। লেখাপড়া করার জন্য নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য নেই সাইক্লোন শেল্টার। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য নেই বেড়িবাঁধ। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নেই কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। বিশুদ্ধ পানির জন্য নেই পর্যাপ্ত গভীর নলকূপ। নেই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। এই নেই আর নেইর মাঝেই জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছেন নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ‘চরনজির’Ñএর মানুষ।
দীর্ঘদিন ধরে চরটিতে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগীতায় এবং দেশী বেসরকারি সংস্থা জাগোনারীর বাস্তবায়নে পরিচালিত প্রদৃপ্ত প্রকল্পের কর্মীরা বলছেন, চরের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সাড়ে তিন কিলোমিটার কাচা রাস্তা, একটি বাশের সাঁকো, নদীপাড়ে একটি ঘাটলা নির্মাণ এবং বিশুদ্ধ পানির জন্য একটি পুকুর খনন করে দেওয়া হয়। জানা গেছে, চরনজিরে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার রয়েছে। তাদের প্রায় সবাই কৃষি ও মৎস্য পেশায় নির্ভরশীল। চরের বাসিন্দারা বলছেন, চরটি ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানকার মানুষেরাও নাগরিক নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন।
ঘরের পাশের যে পুকুরে এই নারী থালা-বাসন ধোঁয়ার কাজ করছেন, তার পাশেই তাদের ব্যবহৃত খোলা টয়লেট। তা জেনেও গৃহস্থলি কাজে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হয় এ পরিবারকে। কারণ নদী ঘেরা এই চরের চারপাশে পানি থই থই করলেও তা লবণাক্ত। বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব। হাতে গোনা ৬-৭টি গভীর নলকূপ আছে। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে তা পর্যাপ্ত নয়। চরের বাসিন্দাদের মতে, নেই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। একারণে ডায়রিয়া ও সর্দি-কাশিসহ নানা রোগবালাইয়ে বারো মাসই ভুগছে এখানকার বাসিন্দারা।
মাঠ পর্যায় কাজ করা প্রদৃপ্ত প্রকল্পের ফিল্ড ফেসিলেটেটর জুয়েল মাহমুদ বলেন, ‘চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রদৃপ্ত প্রকল্প কাজ করছে। ইতোমধ্যে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তা, ঘাট, পুকুর খনন ও সাকো নির্মাণকাজ হয়েছে। কিন্তু শিশুদের লেখাপড়া করার জন্য নেই কোন স্কুল-মাদ্রাসা। তাই শিক্ষা আলোতে নেই সেখানকার বহু শিশু। একারণে পরিবারের সঙ্গে কেউ হয়েছে কৃষি কাজের সঙ্গী, কেউ নদীতে মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য নেই সাইক্লোন শেল্টার। জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য নেই বেড়িবাঁধ। আর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নেই কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা কমিউনিটি ক্লিনিক।’
চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ২০২২ সাল থেকে চরনজিরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ ও জাগোনারী’র প্রদৃপ্ত প্রকল্প। প্রদৃপ্ত প্রকল্পের উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘২০২৪ সালে চরবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৭৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সাড়ে তিন কিলোমিটার কাচা রাস্তা, ১২০ ফুট দৈর্ঘ্য একটি বাশের সাঁকো, ১৪১ ফুট দীর্ঘ আর ৮১ ফুট প্রস্থের একটি পুকুর খনন এবং ৬০ ফুট দীর্ঘ এবং ১২ ফুট প্রস্থের নদীপাড়ে একটি ঘাটলা নির্মাণ কাজ করা হয়। চরের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ জীবনমান উন্নয়নে আরও কাজ প্রয়োজন আছে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘ইতোমধ্যে চরনজিরবাসীর প্রাথমিক শিক্ষা, স্যানিটেশন, সুপেয় পানি সংকট সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর কাজ শুরু করেছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য প্রয়োজনীয় নলকূপ এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের জন্য প্রয়োজনীয় টয়লেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চরটির শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্কুল নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে চরটি জেগে উঠলেও জনবসতি গড়ে ওঠে নব্বইয়ের দশকে। বর্তমানে চরটিতে প্রায় এক হাজারের মত মানুষের বসবাস।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।