
প্রকাশ: ৯ মে ২০১৯, ১৭:৫৯

বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। এদের অধিকাংশ বাহকেরা জানতেও পারেনা যে তারা বাহক। দুজন বাহকে বিয়ে হয়ে গেলে সর্বনাশ। সম্ভাবনা থাকে এদের পঁচিশ শতাংশ বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে, পঞ্চাশ শতাংশ হবে বহনকারী। তবে একজন বাহক আর একজন বাহক নন এমন ব্যক্তির মধ্যে বিয়ে হলে কোন ভয় নেই। বাংলাদেশে প্রতিবছর দেড় হাজার বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে আগামি পঞ্চাশ বছরে থ্যালাসেমিয়ার রোগী দ্বিগুন হয়ে যাবে। ব্যাপারটার ভয়াবহতা কি আমরা বুঝতে পারছি? এখন আমাদের করণীয় কি?
একটা প্রোগ্রাম হাতে নিলেই বড় একটা কাজ হয়ে যাবে। সেটা হলো দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস করার একটা ব্যাবস্থা করা যায়। অথবা শুধু স্কুলগুলোতে রক্তের রুটিন পরীক্ষার ব্যাবস্থা করা। তাহলেই কাদের নিরব এনিমিয়া আছে দেখে নেওয়া যাবে। এভাবে সবাইকেই জানানোর বিষয়টা ব্যবস্থা করতে হবে। ব্লাড গ্রুপের মত সব মানুষ জানুক তার হিমোগ্লোবিনের খবর। সে কি ক্যারিয়ার (বাহক) নাকি নিরব সাফারার? এইটুকু কাজ হলেই হবে। যখন মানুষ জানতে পারবে, তখন দু’জন ক্যারিয়ার (বাহক) বিয়ে করবেনা। বা যদি করেই ফেলে বাচ্চা পেটে আসলে ভ্রুনের পরীক্ষা করিয়ে নেবে। বাচ্চা যদি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়, পৃথিবীতে তাকে এনে কষ্ট দেওয়ার থেকে ভ্রুণেই বিদায় জানানো। এর জন্য সরকার, এনজিও, দাতা গোষ্ঠী সাহায্য দেবে।
আমার দাবীটা একটু বেশিই মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ বছর পর থ্যালাসেমিয়া একটা জাতীয় দু:খ হয়ে যাবে। সাইপ্রাসে এরকম হয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগী ছিল তাদের দেশে। তারা ঠিক উপরের পদ্ধতিতে কাজ করে এখন থ্যালাসেমিয়াকে নিয়ে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশেও সম্ভব। বিষয়টা সবার জানা দরকার। সেই সাথে সবাইকে জানানো দরকার। বাংলাদেশ ইপিআইতে সাফল্য পেয়েছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও। যদি আমরা চাই, তাহলে এখানেও পাওয়া সম্ভব। সেই একই পদক্ষেপ। বিজ্ঞাপন বানানো, প্রচার করা। কোন একজন সেলিব্রেটিকে দিয়ে বিষয়টা বলানো। স্কুল প্রোগ্রাম বা কলেজে শিক্ষকদের দিয়ে বলানো। এইসব আরকি। শুধু একটা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আসুন, থ্যালাসেমিয়াকে জানুন, অন্যকে জানান। ঐক্যবদ্ধ হোন, একটা সুন্দর আগামি গড়ে তুলুন।
আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতিবছরের মতো এ বছরও ৮ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া রক্তের এক বিশেষ ধরনের অসুখ। এটা ক্যানসার নয়, ছোঁয়াচেও নয়। থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রোগ। মানুষের শরীরে কোষের ভেতর যে জিন থাকে, সেই জিন এই রোগের বার্তা বহন করে।
আসুন থ্যালাসেমিয়াকে জানি:
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ:
বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এর উপসর্গও বোঝা যায় না, রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। বিটা থ্যালাসেমিয়া আবার দুই রকমের হতে পারে। একটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এদের থ্যালসেমিয়া ট্রেইট বা ক্যারিয়ার বলে। অপরটি থ্যালাসেমিয়া মেজর। থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট আর থ্যালাসেমিয়া এক নয়। কারণ, এরা মূলত রোগটির বাহক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেকে হয়তো অজান্তেই সারাজীবন এই রোগ বহন করে চলে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। বাবা ও মা উভয়ে থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট হলে ভূমিষ্ঠ শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
উপসর্গ:

পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
চিকিৎসা:
পরিসংখ্যান:
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা খুব জরুরি। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া অনেকখানি কমানো যেতে পারে। দুজন ক্যারিয়ারের (বাহক) মধ্যে যেন বিয়ে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া কমানো সম্ভব। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে বাচ্চা পেটে আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ উপায়ে গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করতে হবে। রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যাবরশন করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ উপায়ে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ কমানো গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছে, আগামী ৫০ বছরে থ্যালাসেমিয়া পৃথিবীজুড়ে একটি বড় রকমের সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। তাই এটি রোধে ব্যাপক সচেতনতা দরকার। সরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, গণমাধ্যম সব দিক থেকেই এই সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। তবেই থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
লেখক: রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন রেসিডেন্ট, হেমাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
ইনিউজ ৭১/এম.আর