ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে মৌলভীবাজার জেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে।
ভারতের উজানে বৃষ্টিপাত না থাকায় মৌলভীবাজারের সবকটি নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে দুর্গত এলাকা থেকে বানের পানি নেমেছে এবং নতুন করে কোনো গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে না।
জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্গত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। জেলা সদর, কমলগঞ্জ, রাজনগর, জুড়ী, বড়লেখা ও কুলাউড়া উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের বাড়ি-ঘরের পানি নেমে গেলেও ময়লা-আবর্জনা, পঁচা দুর্গন্ধে সবার নাভিশ্বাস অবস্থা। এক সপ্তাহ ধরে পানিতে নিমজ্জিত বাসা-বাড়ির অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ও মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী সোমবার (২৬ আগস্ট) সন্ধা ৬টার আপডেট অনুযায়ী মনু নদী (রেলওয়ে ব্রীজ) এর পানি বিপদসীমার ৩০২ সে.মি, নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, মনু নদী (চাঁদনীঘাট) এর পানি বিপদসীমার ৭৫ সে,মি, নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, ধলাই নদী (রেলওয়ে ব্রীজ) এর পানি বিপদসীমার ৩৪০ সে.মি, নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, কুশিয়ারা নদী (শেরপুর) এর পানি বিপদসীমার ১১ সে.মি, নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, জুড়ী নদী (ভবানীপুর,জুড়ী) এর পানি বিপদসীমার ১৫৪ সে.মি, উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বৃষ্টিপাত কমে আসায় মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই, কুশিয়ারা নদীর পানি দ্রুততার সঙ্গে নামছে। এতে বন্যার উন্নতি হচ্ছে। তবে রাজনগর, কুলাউড়া উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বাড়িগুলোতে এখনও পানি আছে।
এদিকে এবারে আকস্মিক বন্যায় জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও মৎস্য চাষিরা।
জেলা মৎস অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় মৌলভীবাজার জেলায় তিন হাজার পুকুর ভেসে যাওয়ায় মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৯ কোটি টাকার বেশি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তর জানায়, বন্যায় ৪৯ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমির ধান ও ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস জানায়, বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাতে ৮৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জেলার কমলগঞ্জ, রাজনগর, জুড়ী, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বাড়ি-ঘর, প্রতিষ্ঠান এবং নদীর বাঁধ। এতে অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পাউবো জানায়, ইতোমধ্যে মনু ও ধলাই নদীর ভেঙে যাওয়া দুটি স্থানের বাঁধ মেরামত কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সোমবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে কমলগঞ্জ উপজেলার বৃৃন্দাবনপুর এলাকার বন্যাদুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই এলাকায় গত দুুইদিন আগে পানি নেমে গেছে। তবে বুকসমান পানি থাকায় ঘরের ভেতরে থাকা অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। আকলিমা আক্তার নামে এক গৃৃহিণী বলেন, বন্যায় আমার সব সম্বল শেষ করে দিলো। আমার ঘর ও উঠানে বুক সমান পানি থাকায় ঘরের যত জিনিসপত্র ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে। হাস-মুরগ, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। গরু-ছাগলেরও খোঁজ পাাচ্ছি না। ঘরে এখন পঁচা পানির দুুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
কমলগঞ্জের কামুদপুর এলাকার আশ্রয় প্রকল্পে থাকা হুমায়ুন মিয়া বলেন, গাং-ছড়া সংলগ্ন এবং নিচু এলাকায় আমাদের বসবাস থাকায় আমরার ঘরে কোমরসমান পাানি জমে ছিল। গত পাঁচদিন ঘরে চুলা জ্বলেনি। কত কষ্টে-দুর্ভোগে ছিলাম ভুক্তভোগি ছাড়া কেউ বুঝবে না।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মাতারপন এলাকার বাসিন্দা হোসেন আলী বলেন, বন্যায় আমার ঘরে কোমরসমান পানি ছিল। আশ্রয়ন প্রকল্পে ছিলাম। গেলো দুই দিনে এসব পানি সরে গেছে। এখন ঘরে ফিরছি।
মনু ও ধলাই নদী পাড়ে বন্যাদুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেলো দুই দিনে মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ উঁচু স্থানের পানি নেমে গেছে। এতে অনেকের বাড়ি ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে যায়। দেখা গেলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনেরা বাড়িঘরে ফিরছেন। অনেকে আবার বন্যায় ধসে পড়া ঘরবাড়ি মেরামতের কাজ করছেন। সেই সঙ্গে ঘরের ভিতর আটকে থাকা কাদা পানি সরাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকে।
রাজনগরের পাঁচগাও ইউনিয়নের ফাহিম হোসেন জানান, এরকম বন্যা আমার জন্মের পর দেখিনি। রাস্তা, উঠান এবং ঘরের ভেতরে বুক সমান পানি। যেদিকে তাকাই সেদিকেই পানি আর পানি। নৌকাই ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। চরম কষ্টে পরিবার নিয়ে অন্যত্র গিয়ে কয়েকদিন অবস্থান করেছি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ সিরাজী জানান, জেলায় তিন হাজার পুকুর ভেসে যাওয়ায় মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৯ কোটি টাকার বেশি।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম খান জানান, জেলার প্রাণিসম্পদ খাতে ৮৪ লাখ টাকা কক্ষতি হয়েছে।
মৌলভীবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, ইতোমধ্যে মনু নদী কুলাউড়া আশ্রয়ণ ও কমলগঞ্জের ধলাই নদী ঘোড়ামারা ভাঙন এলাকায় বাঁধ মেরামত কাজ শুরু করেছে। এ দুইটি বাঁধ মেরামতের পর অন্য ভাঙা বাঁধ মেরামতের কাজ করা হবে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম জানান, জেলার সাত উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯৯৩ জন। তাদের জন্য ১০২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেগুলোতে ১০ হাজার ৯১৭ জন লোক আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যন্ত জেলায় আর্থিক বরাদ্দ আছে নগদ ৪৫ লাখ টাকা। এছাড়া বিতরণ করা হয়েছে ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চাল বরাদ্দ আছে এক হাজার ৫৫০ টন। বিতরণ করা হয়েছে ৮২৬ মেট্রিক টন চাল।
এদিকে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের পক্ষ থেকে বন্যাদুর্গতের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। সোমবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আঁখাইলকুড়া ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন এবং বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালামসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।