দেবীদ্বারে দুই কোটি টাকা নিয়ে উধাও আজিজ কো-অপারেটিভ কর্মকর্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক
শফিউল আলম রাজীব, জেলা প্রতিনিধি কুমিল্লা
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:৩৪ অপরাহ্ন
দেবীদ্বারে দুই কোটি টাকা নিয়ে উধাও আজিজ কো-অপারেটিভ কর্মকর্তা

কুমিল্লা দেবীদ্বারে গ্রাহকের সঞ্চিত প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়ে গাঁ ঢাকা দিয়েছেন উপজেলার এগারগ্রাম বাজারে অবস্থিত আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেড’র জাফরগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক আবদুস ছাত্তার। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জীবনের শেষ সম্ভল হিসেবে টাকা জমা রাখা শতাধিক গ্রাহক। অফিসের সামনে কপাল ঠুকে কাঁদছে অসহায় গ্রাহকেরা।

 

অভিযুক্ত আবদুস ছাত্তারের বাড়ী দেবীদ্বার উপজেলার ইউছুফপুর ইউনিয়নের মুগসাইর গ্রামে।


কথিত ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হতো কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এগারগ্রাম বাজার থেকে। ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা, গ্রাহকের কাছ থেকে ফিক্সড ডিপোজিট ও ডিপিএস নামে টাকা গ্রহন করেছে এটি। ২ বছর আগে এগার গ্রাম বাজারে প্রতিষ্ঠিত হওয়া শাখাটি বন্ধ রয়েছে গত ৮ দিন যাবৎ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কর্মকর্তা আবদুস ছাত্তার পরিবার নিয়ে পলাতক রয়েছেন। 


ওই ঘটনায় প্রতারিত হওয়া ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশিদল গ্রামের আবু তালেবের স্ত্রী শারমিন আক্তার ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আজিজ কো-অপারেটিভ ব্যাংকের জাফরগঞ্জ শাখার ব্যাবস্থাপক আব্দুল সাত্তারকে অভিযুক্ত করে দেবীদ্বার থানায় একটি অভিযোগ পত্র দাখিল করেছেন।


এগারগ্রাম বাজারের ব্যবসায়ি এমজি মামুন বলেন, তার এক নিকট আত্মীয় ওই ব্যাংকে ডিপিএস করেছিলেন। ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে গেলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ১৯৮৪ সালে আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমবায় অধিদপ্তর ঢাকা থেকে নিবন্ধন নিয়ে সারা দেশে কার্যক্রম শুরু করে। ওই নিবন্ধনের আড়ালে ‘আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড’ স্থলে ‘আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেড’ নামে ব্যাংকটি ‘১২ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলে সারাদেশে ১৬০ টি শাখা খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। এরই মধ্যে বে-আইনিভাবে ব্যাংক ব্যবসা করে গ্রাহকদের ৩শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।


তিনি আরো জানান, ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আবদুস ছাত্তার ব্যাংকটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে দেবীদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ বাজারে ‘আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেড’র শাখা কার্যালয়টি’ খুলে শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেন। সেখানে নানা অনিয়মের অভিযোগে গ্রাহকদের রোষানলে পড়ে পালিয়ে যান আজিজ। গত ২০২০ সালের শেষ দিকে ব্রাহ্মণপাড়া এবং দেবীদ্বার উপজেলা সীমান্তে দেবীদ্বার উপজেলার এগারগ্রাম বাজারে একটি কার্যালয় খুলে ‘আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেড’ জাফরগঞ্জ শাখা কার্যালয়ের সাইন বোর্ডটি ঝুলিয়ে আবারো কার্যক্রম শুরু করেন। আর্থিক কোম্পানীর নাম ব্যবহার ও সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে অফিস বানিয়ে গ্রাহকদের সাথে প্রতারনা করে প্রায় ২ কোটিরও অধিক টাকা নিয়ে পালিয়েছে। 

স্বামী পরিত্যাক্তা খোসনেয়ারা বেগম সোসাইটির সামনে কপাল ঠুকে কাঁদছেন আর চিৎকার করে বলছেন, বাজারের বিভিন্ন হোটেলে ঝিয়ের কাজ করে উপার্জিত ২ লক্ষ টাকা কর্মকর্তা সাত্তারের কথায় এক বছরের জন্য ডিপিএস করেছিলাম, গত মাসে তার মেয়াদ শেষ হয়েছে। আমার একমাত্র ছেলে পারভেজকে ঝিয়ের কাজ করে লেখাপড়া শিখিয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজে বিএ ভর্তি করিয়েছি। ছেলেও দোকান কর্মচারীর কাজ করে লেখাপড়া করেছে। আমার স্বামী আমাকে সন্তানসহ ফেলে পালিয়ে যায়। এক শতাংশ খাস জমিতে একটি ছাপড়া তুলে বসবাস করে আসছি। এখন আমার কি হবে ? আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে ? 

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মুগসাইর গ্রামের তাজুল ইসলাম পেনশনের দুই লাখ টাকা শেষ সম্বল হিসেবে জমা রেখেছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে। পেনশনের জমানো টাকা হারিয়ে তিনি এখন বাকরুদ্ধ। এগার গ্রাম বাজারের ফার্মেসী ব্যবসা করেন আবদুল কাদির। তিনি দুই নামে দশ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন। তার মতো কম করে হলেও ৬০জন গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন।


মহিলা মাঠ কর্মী সোনিয়া আক্তার জানান, তিনি এ প্রতিষ্ঠানে গত দু’বছর ধরে চাকরি করছেন, নিজের ১৬ লক্ষ টাকা সহ আত্মীয় স্বজনের প্রায় ২৩ লক্ষ টাকার ডিপিএস করেছিল সে। কোম্পানীটি যে ভুঁয়া তা কখনোই কল্পনা করেননি। এক লক্ষ টাকায় বার্ষিক ১২ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভনে গ্রাহক তৈরী হতে থাকে। মাসিক ডিপিএস এর লভ্যাংশ গ্রাহকরা নিয়মিত পাওয়ায়  গ্রাহকদের মধ্যে কোন সন্দেহের দানা বাঁধেনি। দিন দিন গ্রাহক বাড়তে থাকে। কিছু বার্ষিক আমানতকারীদের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ওরা টাকা দাবী করে। আজ- কাল দেব বলে হঠাৎ গত ২৭ আগষ্ট ব্যাংক তালা দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার পালিয়ে যায়। এখন গ্রাহরা তাদের পাওনার দাবীতে আমার বাড়ি ছাড়ছেনা। 

এই বিষয়ে অভিযুক্ত আবদুস ছাত্তারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেস্টা করা হলে, ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।


এব্যপারে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন জানান, সংবাদ পেয়ে এলাকায় তদন্তে গিয়েছিলাম।  আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন এনে কার্যক্রম শুরু করে। বেআইনি ভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করলে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের অনুমতি এনে ব্যাংকিং কার্যক্রম বাদ দিয়ে আবারও কার্যক্রম শুরু করে। এগারগ্রাম এলাকা ঘুরে ১৫ জন গ্রাহকের অভিযোগ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন জেলা এবং ঢাকা কার্যালয়ে পাঠিয়েছি।


দেবীদ্বার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কমল কৃষ্ণধর বলেন, এগারো গ্রামের শারমিন আক্তার নামে একজন মহিলা টাকা প্রতারনার অভিযোগে একটি অভিযোগপত্র থানায় জমা দিয়েছে। আমরা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব। তবে মানিলন্ডারিং আইনের বিষয় যেহেতু, তাদের আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দিয়েছি।


এই বিষয়ে দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক উন-নবী তালুকদার বলেন, ঘটনাটি জানার পর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাকে বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলে নির্দেশ দিয়েছি।