মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ একাধিক বাধার মুখে পড়েছে। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি একেবারে মন্থর। বিএসএফের বাধা, জমি অধিগ্রহণের জটিলতা, এবং অর্থসংকটের কারণে চার বছরেও এই প্রকল্পের মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ৫টি স্থানে বাংলাদেশ অংশে বাঁধের কাজ সম্পন্ন হতে পারেনি। তবে, ভারতের অংশে বিএসএফের উপস্থিতিতে কাজ দ্রুত গতিতে চলছে এবং সেখানে কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই পরিস্থিতি বন্যা প্রবণ এলাকাগুলোর স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, যেহেতু তারা প্রতিনিয়ত বন্যা ও নদীভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা খুবই হতাশ। ২০২৪ সালের আগস্টে ভয়াবহ বন্যায় কুলাউড়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের ঘরবাড়ি এবং ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন যে, বিএসএফের বাধায় বাংলাদেশ অংশে বাঁধ নির্মাণের কাজ থমকে গেছে, তবে ভারতের অংশে সীমানা সংলগ্ন এলাকায় কাজ চলছে। স্থানীয়রা জানান, যখনই নদীতে পানি বাড়ে, তখন তাদের গ্রামগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। বন্যার সময় এই এলাকাগুলোতে বন্যা ও নদীভাঙন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ ফুট বাঁধের কাজ এখনও শুরু হয়নি। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মাগুরউলি ও দেবীপুর এলাকায় বিএসএফের তত্ত্বাবধানে বাঁধের কাজ দ্রুত চলছে। স্থানীয় বাসিন্দা রাসেল আহমদ, জসিম মিয়া, ও আতিক হোসেন জানান, ২০২৪ সালের বন্যায় তাদের এলাকার মানুষজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু না হওয়ায় বন্যার পুনরাবৃত্তি নিয়ে তারা চরম উদ্বিগ্ন। তারা আরো বলেন, বিএসএফের বাধায় বাংলাদেশ অংশে কাজ বন্ধ থাকলেও ভারতে কাজ চলছে, যা তাদের অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করেছে।
এদিকে, নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতা ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বলেন, কুলাউড়া উপজেলায় মনু নদীর খরস্রোতা চরিত্র এক ধরনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, নদীভাঙন এবং বন্যা সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখের কারণ হচ্ছে, বছরের পর বছর ধরে তাদের সহায়ক বাঁধগুলোর নির্মাণ কাজ ঠিকভাবে এগোচ্ছে না। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ভারতীয় সীমান্তের কাজ শেষ হলে বিএসএফ আরও কঠোর হয়ে উঠবে, যা বাংলাদেশের জন্য আরও বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, মনু নদী রক্ষা প্রকল্পের জন্য ২০২০ সালে ৯৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রকল্পে মোট ২৮টি প্যাকেজের কাজ রয়েছে, যার মধ্যে ২০টি স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষা কাজ এবং ৪টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনারাকৃতিকরণ কাজ রয়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সীমান্তের বাধা এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর হয়েছে। বর্তমানে কুলাউড়া উপজেলার ৪টি স্থানে কাজ চলছে, কিন্তু বিএসএফের বাধায় এই কাজগুলোও থমকে গেছে।
স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছে, কিন্তু সাড়া মেলেনি। একাধিকবার তারা মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দিয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। তবে, সরকার এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং চলতি মাসে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ গত ২১ এপ্রিল মনু নদীর বাঁধ পরিদর্শন করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
এই প্রকল্পের মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, রাব্বানী কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার রুবেল আহমদ জানান, তাদের মন্দিরা এলাকায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু কাজের বিলের জন্য তারা হতাশ। তিনি বলেন, কিছু ঘর পুনর্বাসন না করায় কাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ জানান, বিএসএফের বাধায় কাজ বন্ধ থাকলেও, অন্যান্য এলাকায় কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
এদিকে, ২০২৩ সালে যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়েছে, তবে এখনও পর্যন্ত কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। গত মার্চ মাসে কলকাতায় উভয় দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হলেও, এখন পর্যন্ত কোনও সমাধান আসেনি।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে কুলাউড়া উপজেলার হাজার হাজার মানুষের জন্য আগামী বর্ষা মৌসুমে ফের বন্যা ও নদীভাঙনের নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি হতে পারে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।