প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২১, ০:৪৯
প্রথমধাপে বরিশাল জেলার দশটি উপজেলার মধ্যে একমাত্র আগৈলঝাড়া ব্যতিত নয়টি উপজেলার ৫০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আগামী ২১ জুন ভোটগ্রহণ করা হবে। তবে দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচনী মাঠ ততোই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিন দফায় দফায় হামলা, ভাংচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন ইউনিয়নে। এমনকি নির্বাচনী উঠান বৈঠকে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের এলাকা ছাড়া করার প্রকাশ্য হুমকির ঘটনাও শোনা যাচ্ছে। বড়ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কায় চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন সাধারণ ভোটাররা। তারা চান নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ।
এদিকে নির্বাচন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গত শনিবার (১২ জুন) বরিশাল সার্কিট হাউজের সভা কক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার একেএম নুরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনে প্রার্থী কোন দলের, বর্ণের বা ধর্মের তা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের কাজ হচ্ছে সবাইকে সমান সুযোগ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা।
জেলার ৫০টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ৩৬টির মধ্যে দুইটি ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নৌকার প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছেন।
কোন ইউনিয়নে বিএনপিসহ অধিকাংশ বড় দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ৩৪টি ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন দলের ত্যাগী নেতারাই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করলেও এরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৃণমূল পর্যায়ের ভোটারদের সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের চাঁপে তারা অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পরেছেন। তারা (স্বতন্ত্র প্রার্থী) মাঠে নামলেই হামলা চালিয়ে নির্বাচনী মাঠ অশান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ সুযোগে কয়েকটি ইউনিয়নে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে এককালের মুর্তিমান আতঙ্ক সর্বহারা সন্ত্রাসীরা।
সূত্রমতে, গত ২ জুন নির্বাচন কমিশন নতুন করে আগামী ২১ জুন স্থগিত নির্বাচনের দিনক্ষন ধার্য করার পর সরগম হয়ে ওঠে জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার নির্বাচনী মাঠ। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি স্থানীয় সরকারের চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহন না করার ঘোষনা দেয়ায় এসব ইউনিয়নে বিএনপির কোন প্রার্থী নেই।
নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীক পেয়েছেন বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নে নুরে আলম বেপারী, দেহেরগতি ইউনিয়নে মোঃ মশিউর রহমান, মাধবপাশা ইউনিয়নে মোঃ জয়নাল আবেদীন এবং জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নে সরদার তারিকুল ইসলাম তারেক।
জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন ॥ এককালের সর্বহারা অধ্যুষিত উত্তর জনপদ বলে খ্যাত বাবুগঞ্জ উপজেলার বর্তমান বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর (সাবেক আগরপুর) ইউনিয়নের নির্বাচনের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই অশান্ত হয়ে উঠেছে ওই ইউনিয়নের প্রতিটি জনপদ।
গত কয়েকদিনে এখানে নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ওই ইউনিয়নের নৌকা মার্কার প্রার্থী তারিকুল ইসলাম তারেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার খালেদ হোসেন স্বপনের বড় ভাই। ফলে স্বপনের উপস্থিতিতে ও তার প্রভাবে ইউনিয়নের সর্বত্র সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওই ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আনারস প্রতীক নিয়ে মাঠে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়ের আপন চাচাতো ভাই এবং সাবেক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল আহসান হিমু খান।
আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী অধ্যাপক কামরুল আহসান হিমু খান ও তার সমর্থকদের নির্বাচনী এলাকা ছাড়া করার হুমকি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান প্রার্থী তারিকুল ইসলাম তারেক। মঙ্গলবার রাতে ও বিকেলে দুইটি নির্বাচনী উঠান বৈঠকে প্রকাশ্যে এ হুমকি দেয়া হয়েছে।
বুধবার সকালে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান হিমু খান অভিযোগ করেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা মার্কার প্রার্থী তারিকুল ইসলাম তারেক তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও ভোটারদের কাছ থেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা রাতে ইউনিয়নের জাহাপুর ও বিকেলে রমজানকাঠীর বুধিঘাটা এলাকার নির্বাচনী উঠান বৈঠকে তারিকুল ইসলাম তারেক তার বক্তব্যে প্রকাশ্যে বলেন, আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী কামরুল ইসলাম হিমুকে এবং ১৮ জুনের মধ্যে তার সমর্থকদের নির্বাচনী এলাকা ছাড়া করা হবে।
এ ব্যাপারে তিনি (হিমু খান) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা হিমুর পক্ষে অবস্থান করছেন। সাধারণ ভোটাররা জানিয়েছেন, সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটগ্রহণ করা হলে আনারস মার্কা বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবে।
ফলে ভোটারবিহীন প্রার্থী তারেকের ভাড়াটিয়া লোকজনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিমুর কর্মীদের মাঠেই দাঁড়াতে দিতে চাইছেন না।
অপরদিকে গত কয়েকদিন থেকে মধ্যরাতে ফাঁকা গুলির শব্দে ওই ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আটটার দিকে ওই ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর শিলনদিয়া রাস্তার মাথা নামক এলাকায় বসে নৌকার প্রার্থীর উপস্থিতিতে তার সমর্থক ও ভাড়াটিয়া লোকজনে হামলা চালিয়েছে।
এসময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ব্যবহৃত দুইটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও একটি ভাঙচুর করা হয়।
দেগেরগতি ইউনিয়ন ॥ এ ইউনিয়নের নৌকা মার্কার প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মশিউর রহমান টানা দুইবার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সময়ে দেহেরগতি ইউনিয়ন উন্নয়নের জনপদে পরিনত হয়েছে।
আর এ কারণে এখানে নৌকা মার্কার প্রার্থী মশিউর রহমানের বিজয়ী হওয়া অনেকটা নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন সর্বস্তরের ভোটাররা।
নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁপটি মেরে থাকা তৎকালীন সময়ের দুর্র্ধষ সর্বহারা ক্যাডার ও পাশ্ববর্তী উপজেলার সন্ত্রাসীরা বিশেষ এক প্রার্থীর পক্ষালম্বন করে নির্বাচনের মাঠে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তাদের টার্গেট নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারেন। এজন্য ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী ও দেশে ফেরা এককালের সর্বহারা সন্ত্রাসীরা নির্বাচনের পূর্বে হত্যাকান্ডের মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটাতেও প্রস্তুত রয়েছে।
বাবুগঞ্জ থানার ওসি মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমানে ওই ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন অবস্থাতে কাউকে সংঘাত করতে দেয়া হবেনা। সেজন্য পুলিশ সদস্যদের কঠোর অবস্থানে রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুলাদী উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সর্বহারা সন্ত্রাসীরা। ইতোমধ্যে চরকালেখা ইউনিয়নের সাধারণ ভোটারদের বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ॥ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দরা হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া, হরিনাথপুর, মেমানিয়া ও বড় জালিয়া ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থীদের পক্ষে গণসংযোগ এবং পথসভা করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থীতা প্রত্যাহারের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা না হলে তাদের (স্বতন্ত্র প্রার্থী) বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
শনিবার বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এ আল্টিমেটাম দিয়েছেন।
ভোটারদের চোখে ॥ বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়ীয়া ইউনিয়নে মোট চারজন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তারা হলেন-নৌকার প্রার্থী বাহাউদ্দীন আহমেদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সচিব এআর খানের স্ত্রী নাদীরা রহমান, নসরুল আলম এবং জব্বার মোল্লা।
স্থানীয় ভোটাররা জানান, বাহাউদ্দীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও অন্য তিনজন স্বতন্ত্র হয়ে লড়ছেন তারাও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত। যেহেতু বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থী নেই। তাই ভোটাররা সবাইকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনে করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন ‘যে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসবে সে-ই আমার’। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, কাউকে প্রতীক দেওয়া হয়েছে, কাউকে দেয়া হয়নি। কিন্তু সবাইতো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে।