কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলা থেকে ঐতিহ্যবাহী টেঁকি। এক সময়ের কৃষাণ-কৃষাণিদের ভালো মানের চাল তৈরির প্রধান মাধ্যম ছিলো ঢেঁকি। গ্রামেগঞ্জে এখন পুরোপুরি লেগেছে আধুনিকতার ঢেউ। কালের বিবর্তনে পুরোপুরি হারিয়ে গেল ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ।ধান থেকে চাল, তা থেকে আটা। একসময়ে চাল আর আটা প্রস্তুতের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঢেঁকি। বিশেষ করে শীতের আগমনে ঢেঁকির পাড়ে ধুম পড়ত নতুন ধানের চাল ও আটা তৈরির।
গ্রামেগঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় এক সময় ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি, চিড়া ভাঙা, আটা, পায়েসের চালের গুঁড়ো, খির তৈরির চাল বানানোর সেই ঢেঁকি- আজ হার মেনেছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনের কাছে। ধান ভানা, চাল গুঁড়ো করা, বড়ি তৈরি করা, আটা তৈরি চালের গুঁড়াসহ ঢেঁকির যাবতীয় কাজ এখন করছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনে। ঢেঁকি নিয়ে এক সময় জনপ্রিয় গান রচিত হয়েছিল।
ও বউ ধান ভানেরে/ঢেঁকিতে পার দিয়া/ ঢেঁকি নাচে বউ নাচে/ হেলিয়া, দুলিয়া/ ও ধান ভানেরে… পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের ঢেঁকি নিয়ে এই কবিতা এখনো থাকলেও নানান স্মৃতির এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
ঢেঁকি তৈরির জন্য গাছ কেটে ৬ ফুট লম্বা এবং ৫-৬ ইঞ্চি পুরত্বের কাঠের খণ্ড আলাদা করতে হয়। মাথার দিকটা সুরু মোটা ও পায়ের দিকটা চ্যাপ্টা আকৃতির বানাতে হয়। মাথার দিকে দেড় থেকে দুই ফুটের শুঁড় সংযোজন করতে হয়। যাকে বলে মুষল, কেউ বলে চুরুন। মুষলের শেষ দিকে বসানো থাকে লোহার চাকতি। ঢেঁকি যেখানে বসানো হয়, সেখানে ঢেঁকির মাথার দিকে গর্ত খোঁড়া হয়।
এই গর্তকে বলা হয় নোট, গর্তের মধ্যে পাথর বা কাঠ খোদাই করে বসানো হয়। ঢেঁকির পেছনের দিকটা থাকে একটি ফ্রেমে আটকানো, যাকে বলে কাতলা। কাতলা থেকে বর্ধিত অংশে পা দিয়ে চাপ দিলেই শুরু হয় ঢেঁকির নাচন।
সাধারণত ২-৩ জন মহিলা এ যন্ত্রে কাজ করেন। ১-২ জন মুষল উত্তোলনের জন্য ধড়ের এক প্রান্তে পা দিয়ে পালাক্রমে চাপ দিয়ে থাকেন এবং পা সরিয়ে নিয়ে মুষলকে নিচে পড়তে দেন। অপর মহিলা বৃত্তাকার খোঁড়ল থেকে চূর্ণীকৃত শস্য সরিয়ে নেন এবং তাতে নতুন শস্য সরবরাহ করেন। মুষলের আঘাত ধারন করার জন্য খোঁড়লটি কাটা হয় মাটিতে বসানো এক টুকরা শক্ত কাঠের গুঁড়িতে।
ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার কাজ খুবই শ্রমসাপেক্ষ। কাজটিতে মহিলাগণ একে অপরের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু কোনো কোনো সময় একজন মহিলা সম্পূর্ণ কাজটি একাই করে থাকেন। এ কাজে তিনি একটি লম্বা হাতলের মাথায় নারিকেলের মালা (খোল) বেঁধে তৈরি করা চালুনির সাহায্যে খোঁড়লে শস্যদানা ভরা ও বের করার কাজ করেন।
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় কোথাও ঢেঁকির শব্দ নেই। ফলে বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি ঢেঁকি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎ নেই, সেখানেও ঢেঁকির ব্যবহার কমেছে। গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কেউ কেউ বাড়িতে ঢেঁকি রাখলেও ব্যবহার করছে না। যন্ত্র আবিষ্কারের আগে ঢেঁকি শিল্পের বেশ কদর ছিল। তেল বা বিদ্যুৎ চালিত মেশিন দিয়ে ধান ও চাল ভানার কারণে ঢেঁকি আজ কদরহীন।
৭৮ বছর বয়সী বছিরন বলেন,আমাদের বাড়িতে এখনো একটি ঢেঁকি রয়েছে।কিন্তু এই ঢেঁকি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।আগে কত রকমের গান গাইতাম আর ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে গুঁড়া করতাম।এখন সেগুলো শুধুই স্মৃতি।৬৯ বছর বয়সী বেঙ্গুলি বেওয়া জানান,এখন তো কোনো বাড়িতে ঢেঁকি চোখেই পড়েনা।অথচ আগে প্রায় বাড়িতেই ঢেঁকি ছিল।
বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ঘুরেও এখন ঢেঁকির দেখা মেলে না। ঢেঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে অনেকেই জানান, আগে প্রায় সবার বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। সেই ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের পিঠার গন্ধ এখন আর নেই। পিঠার স্বাদ ও গন্ধ এখনো মনে পড়ে। আধুনিক প্রযুক্তির ফলে গ্রামবাংলায় ঢেঁকির ব্যবহার কমে গেছে।
ঢেঁকি আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। তাই এ শিল্প রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য সবার সহযোগিতা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।তাছাড়া এখন আর কারোর বাড়ীতে ঢেঁকি পাওয়া যায় না।”ঢেঁকির ঢেঁক ঢেকানি আর শোনা যায়না। শুধু উপজেলা নয় জেলার প্রায় সকল অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প। তাইতো কবির ভাষায় বলি-
“তব রাজপথে চলিছে মোটর সাগরে জাহাজ চলে
রেলপথে চলে রেল ইঞ্জিন দেশ ছেয়ে গেছে কলে।”
#ইনিউজ৭১/জি/হা/২০২১