পান পাতার গ্রাম এখন নওগাঁয়!

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২০শে এপ্রিল ২০২১ ০২:৫১ অপরাহ্ন
পান পাতার গ্রাম এখন নওগাঁয়!

নওগাঁ সদর উপজেলা থেকে ১১কিলোমিটার দূরে কির্ত্তিপুর ইউনিয়নের সবুজে ছাঁয়াঘেরা সুনিপন ছোট্র তিনটি গ্রাম জালম, মাগুড়া এবং জাগেশ্বর। গ্রাম তিনটিতে বসবাস প্রায় আড়াই হাজার মানুষের। গ্রাম গুলোতে পৌঁছালে  দেখা মিলবে সাড়ি সাড়ি পানের বরজের। তিন গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির মানুষ কৃষি জমিতে পানের বরজ গড়ে তুলেছেন। গ্রাম গুলো এখন পান পাতার গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে।


এলাকার চাষিরা ধানের পাশা-পাশি পান পাতার চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবহাওয়া এবং চাষ পদ্ধতি অনুক‚ল, উঁচু, বন্যামুক্ত, বেলে দোআঁশযুক্ত জমি হওয়ায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পান পাতার চাষ। পান চাষের জন্য জমিকে আগাছামুক্ত, সমতল ও উঁচু করে তৈরি করে প্রতি ৬০ সে.মি পর পর ২০ সে.মি চওড়া করে নালা তৈরি করে নিতে হয়। বরোজের বাইরে একটি বড় নিকাশ নালার সাথে ছোট নালাগুলোকে যুক্ত করা হয় ।


স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত প্রায় ১৫বছর থেকে তিনটি গ্রামের প্রায় ৩০০জন কৃষক প্রায় ৭শতাধিক বরজে পান পাতার চাষ করছেন। স্থানীয় পান চাষিরা জানান, পান চাষে ধানের থেকে লাভ বেশি। যার কারনে  নিজস্ব জমিতে পানের বরজ তৈরি করে পান চাষ করছেন। সংসারের কাজের পাশা-পাশি পানের বরজ তৈরি করে সারা বছর বরজ থেকে পান পাতা সংগ্রহ করে খুচরা ও পাইকারি দরে বিক্রি করে সংসারে ফিরে এসেছে স্বচ্ছলতা। এই এলকায় মূলত বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজানী, মাঘিসহ কয়েক জাতের পান চাষ করা হচ্ছে। 


মাগুড়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা অরুপ কুমার মন্ডল ও বিকাশ চন্দ্র মন্ডল জানান , গত তিন চার বছর থেকে অনেকে নতুন করে ঝুকেছেন পান চাষে। প্রায় তিন শতাধিক পরিবার পান চাষের সাথে যুক্ত। তারা বলেন, ধানের চেয়ে বর্তমানে পান চাষ বেশি লাভজনক এছাড়া সারা বছর পান চাষ করা যায়। যার কারনে এই এলাকার অনেক কৃষক এখন পান চাষে ঝুকছেন।


জালম গ্রামের পান চাষি বিধান চন্দ্র বলেন, আমি গত প্রায় ১০বছর যাবৎ পান চাষ করে আসছি। বর্তমানে ৫বিঘা জমিতে পানের চাষ করেছি। পান চাষের জন্য খচর ও লাভের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে প্রায় এক লক্ষ দশ হাজার টাকার মত খরচ হয়। বাঁশ ৩০০ পিচ, যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০,০০০ টাকা, সেচ খরচ ২০,০০০ টাকা, ডিএপি সার ৩০ কেজি, মূল্য ৪৮০ টাকা, এমওপি সার ২৫ কেজি, মূল্য ৪০০ টাকা, জিং সার ২ কেজি মূল্য ৩০০ টাকা, বোরন সার ২ কেজি, মূল্য ৩২০ টাকা, ম্যাগনেসিয়াম সালফার ২ কেজি মূল্য ৬০ টাকা, জিপসাম সার ১২ কেজি মূল্য ৩৬০ টাকা, ইউরিয়া সার ১০ কেজি মূল্য ১৬০ টাকা, কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক প্রায় ৩০০০ টাকা এবং পরিচর্যার জন্য শ্রমিক বাবদ প্রায় ৪৫০০০ হাজার টাকা। 


বিধান চন্দ্র বলেন, একটি পানের বরজ সংস্কার ছাড়া প্রায় ৫-৬ বছর যাবৎ পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে। এক বিঘা জমির বরজ  থেকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুই বার পান পাতা সংগ্রহ করা যায়। সে হিসেবে প্রতি সপ্তাহে  ২ পোয়া ( ৪ হাজার ৯৬পিচ ) পান পাতা উঠানো ক্ষেত থেকে। বর্তমান স্থানীয় বাজার দর অনুযায়ী বড় পান ১ পোয়া ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা, মাঝারি পান ১ পোয়া ১ হাজার ১৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ এবং ছোট পান ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। 


কথা হয় জাগেশ্বর গ্রামের পান চাষি সুনিল চন্দ্র প্রামানিক এর সাথে, তার কাছে জানতে চাওয়া হয় প্রতি বিঘা পানের বরজ থেকে বাসৎসরিক কি পরিমান লাভ এবং পানপাতা গুলো কোথায় বিক্রি করা হয় সে সম্পর্কে, এসময় তিনি বলেন, আমি ৭বিঘা জমিতে পানের আবাদ করেছি। এক বিঘার জমির একটি বরজ থেকে মৌসুমে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার পান পাতা বিক্রি করা হয়। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ক্ষেত থেকে দুই বার পান পাতা সংগ্রহ করা যায়।

সুনিল বলেন, উৎপাদিত পান পাশ্ববর্তী জয়পুরহাট, দিনাজপুর,রাজশাহী দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয় এবং অনেক পাইকারী ব্যবসায়ীরা এসে নিয়ে যায়। শুধু মাত্র বর্ষা মৌসুমে দলাপচা রোগ দেয় তখন কৃষি অফিসের পরামর্শে অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া তেমন কোন গুরুতর রোগবালাই হয়না।


কির্ত্তিপুর ইউনিয়ন এর দায়িত্বে নিয়োজিত উপ সহকারী কৃষি অফিসার বিমল চন্দ্র রায় জানান, নওগাঁ জেলায় শুধু মাত্র সদর উপজেলার কির্ত্তিপুর ইউনিয়ন এর জালম, মাগুড়া এবং জাগেশ্বর এই তিনটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে পানের চাষ হয়ে থাকে। গতবছর ১০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছিল। চলতি বছর তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫হেক্টর জমিতে পানের চাষ করা হচ্ছে।  সারা বছরই পান পাতা পাওয়া যায়। তেমন কোন গুরুতর রোগ-বালাই নেই, তবে বর্ষা মৌসুমে দলাপচা নামে একটি রোগ দেখা দেয়। স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে পান চাষিদের সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে বলে জানান স্থানীয় এই কৃষি অফিসার।


#ইনিউজ৭১/জিয়া/২০২১