আমার জেলা শেরপুরের নকলা উপজেলার একজন খবরের কর্মী ইউসুফ মণ্ডল। দীর্ঘদিন ধরেই গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত। এখন কাজ করেন বিজয় টিভি’র নকলা প্রতিনিধি হিসেবে। আমি তাকে যখন জানতাম, তখন সম্ভবত ভোরের কাগজের নকলা প্রতিনিধি ছিলেন। দীর্ঘদিন পর তাকে দেখতে পেলাম সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করা এক ছবিতে। ভুল না হলে ছবিটি হাসপাতালের। ছেড়া জামা, রক্তাক্ত মুখ নিয়ে তিনি পড়ে আছেন, জরুরি বিভাগের শয্যায়।
ইউসুফ মণ্ডলকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন। এমনিতেই গণমাধ্যম রক্তাক্ত নানা কারণে। কথায় কথায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভয় দেখানোর বিষয়টি তো রয়েছেই। রয়েছে হয়রানির আরো নানা কায়দা-ফিকির। ঘটনাটি যতটুকু জানতে পারলাম, নকলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের একজন কর্মচারী তাকে মারধর করেছে। ফলে ইউসুফ আহত হয়ে হাসপাতালে। অবস্থা কতদূর গিয়েছে, খবরের কর্মীরা আন্দাজ করতে পারছেন কি? আগে জেলা বা উপজেলার প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের সাথে গণমাধ্যমকর্মীদের কথা হতো। কখনো বাদানুবাদও হয়েছে। সেই বাদানুবাদ একসময় রূপ নিয়েছে মামলায়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সেই মামলার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও লড়াইটা ছিলো মর্যাদার। কিন্তু অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও একজন গণমাধ্যমকর্মীর গায়ে হাত তোলার সাহস পায় এবং পায়, কিছু হয় না বলেই।
জানি, গনমাধ্যমকর্মীদের সবাই ধোয়া তুলশীপাতা নন। যেমন নন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। কানাডার বেগমপাড়ার বড় অংশের দখল রয়েছে সরকারি লোকজনের। সেই দুর্নীতির বিষয়গুলো তো এখন প্রকাশ্য। গণমাধ্যমকর্মীরাও এর বাইরে নন। তারাও মানুষ; ষড়রিপু তাদেরও কাবু করে। তাদেরও ইচ্ছে হয় গাড়ি-বাড়ি, ঠাট-বাটের। কথায়ই তো রয়েছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। সুতরাং সর্বনাশ গণমাধ্যমকর্মীদেরও হয়েছে। কিন্তু তা হলেও, মারধরের অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। অন্তত রাষ্ট্রব্যবস্থার হাল এতটা খারাপ হয়নি যে, ‘খুল্লাম খুল্লা’ মারধরের অনুমোদন দেবে। ইউসুফ মণ্ডলসহ যেসব গণমাধ্যমকর্মীর গায়ে হাত তোলা হয়েছে, তা রীতিমত অপরাধ এবং সে অপরাধ না বুঝে নয়, জেনেশুনে। আগেই বলেছি, রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুমোদন না থাকলেও, অব্যবস্থায় রেহাই পেয়ে যায় অপরাধীরা। সে কারণেই গণমাধ্যমকর্মীরা এবং গণমাধ্যম খোদ রক্তাক্ত হয়। আর সে রক্তের দাগ লাগে রাষ্ট্রের শরীরেও।
মারধরের ব্যাপারটি প্রমাণ করে ডিজিটাল সিকিউরিটির মতন একটা দানবীয় আইন, যাতে কিনা দেশ-বিদেশের সবারই আপত্তি, তাতেও মন ভরছে না কারো কারো। তারা গণমাধ্যমকর্মীদের পিটিয়ে হাতের এবং মনের সুখ মেটাতে চায়। আর এমন স্যাডিস্ট চিন্তার সর্বশেষ পরিণতিই সম্ভবত গণমাধ্যমকর্মীদের হত্যাকাণ্ডগুলো। মামলার পর মাধধর এবং তাতেও মন না ভরলে অ্যাসাসিনেশন। কী ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছেছি আমরা। কী অসম্ভব বৈরী সময়ের মধ্যে বাস করছি।
দোষ দিতে পারেন, বলতে পারেন, এরজন্য দায়ী গণমাধ্যমের সাথে যুক্তরাও। অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। স্বীকার করে নিচ্ছি। বিভাজন, রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি, লোভ, হঠকারিতা সবমিলিয়ে গণমাধ্যমের মানুষদেরও সর্বনাশ ঘটেছে। পচন শুরু হয়েছে মাথা থেকে। আর সঙ্গত সর্বনাশ ঘটেছে নিচের দিকেও। ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, মলম লাগাবো কোথা’ অবস্থা। নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে, গণমাধ্যমের একটা অংশ বোধহয় সেই বোধের সীমাও অতিক্রম করেছে।
না, এতটা লিখলেও ততটা হতাশ এখনো হইনি। এখনো প্রশাসনে ভালো মানুষ রয়েছেন। যে পুলিশকে নিয়ে এত কথা, সেখানেও অনেক সৎ মানুষ আছেন। যাদের অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং জানি। গণমাধ্যমেও অনেক কমিটেড ও ডেডিকেটেড মানুষ রয়েছেন। মুশকিল হলো, তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। ভালোমানুষদের সমন্বয়হীনতার সুযোগে খারাপ মানুষগুলো তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে। এ অবস্থার নিরসনে ভালো মানুষদের পরস্পরের সাথে লিঙ্কআপটা জরুরি। তবেই যদি আবার সব ঠিকঠাক হয়। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে, আমরাও আশার খড়কুটো ধরে আছি। ভেসে যাচ্ছি জানি, তবুও কূলে ওঠার ব্যাকুল ইচ্ছে নিয়ে আছি।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।