১৯৭১ সাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা “এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” যা মূহুর্তের মধ্যেই ৭ কোটি বাঙালীর মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতাকামী মানুষ সেই এক ডাকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে এনেছিল লাল সবুজের বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
২০২১ সাল। বিস্তর ফারাক। মাত্র ৫০ বছর। তবে ঊনপঞ্চাশের ব্যবধানে আমাদের লোকসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি ছুঁই ছুঁই (মতভেদে ১৮ কোটি)। আর ঊনপঞ্চাশে এসে আমরা সেই ৭১’র মতোই ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছি। তবে এবার বিষয় ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। শুধু আমরাই না, সমগ্র বিশ্ব ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা ভাইরাস সেই ক্রান্তিকালের জন্মদাতা।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের শেষের দিকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত ২১৮ টি দেশ বা অঞ্চলের ২৮ লাখের উপর মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আর আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ।
আমাদের দেশে ২০২০ সালের ৮ই মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত (১ এপ্রিল ২০২১) মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৪ জনে। আর প্রাণ হারিয়েছে ৯ হাজার ১০৫ জন।
করোনার প্রথম ওয়েভে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানী ঘটেছে গত বছর ৩০ জুন। ওই দিন দেশে সর্বোচ্চ ৬৪ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আর দ্বিতীয় ওয়েভে ১ এপ্রিল ২০২১ করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের, আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৯ জন।
ভয়াবহ করোনা ভাইরাস এক বছর সমগ্র বিশ্বে মানুষের জীবনকে করেছে বিপর্যস্ত। প্রথম দিকে মানুষের মধ্যে উৎকন্ঠা, উদ্বেগ, ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য না থাকা, গুজব, কোন ওষুধ বা টিকা না থাকা সব মিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা বিরাজ করে। ওই সময় অনান্য দেশের মত জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী বার বার হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর গুরুত্বারোপ করে সরকার। দেশ ও জাতিকে রক্ষায় সমগ্র দেশব্যাপী লকডাউন এবং সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিছুদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে লকডাউন তুলে নিলেও এখনো বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এদিকে চলতি বছরের শুরুর দিকে টিকা আবিস্কার হওয়ার পর মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। অনেকের মধ্যেই ঢিলেঢালা মনোভাব শুরু হয়। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হয় প্রায় সর্বক্ষেত্রে। তবে টিকা উদ্ভাবনের তিন মাসের মাথায় আবারও ভয়াবহ রূপে আবির্ভাব ঘটে করোনা ভাইরাসের। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। নতুন করে করোনা সংক্রমনের হার বাড়তে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) ১৮ দফা নির্দেশনা জারী করা হয়। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতি সেকেন্ডে সাত দশমিক সাত শতাংশ মানুষ করোনা নামক মহামারী এই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে জনগণকে তাগিদ দিচ্ছেন। বিশেষ করে নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বলা হলেও আমরা এখনও তা আমলে নিচ্ছিনা। আমি, আমার পরিবার বা সমাজের জন্য আমারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সঠিক স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে নিজেকে বাঁচানো এবং অন্যকে বাঁচতে সহযোগিতা করা সম্ভব।
এবার আসি মূল কথায়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে বিশ্বব্যাপী সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার এত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কারও কারও কাছে যেন তা রুটিনওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন বয়সী সব জনগোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হলেও যুবসমাজের কাছে তা যেন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগকে অনেকে ‘ভাইরাল’ যুগ বলে সম্বোধন করে। এই যুগে ভাইরাল হয়ে অনেকেই রাতারাতি তারকা বনে গেছেন। আবার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে বিখ্যাত অনেকেই খলনায়কে পরিণত হয়েছেন।
আজকাল তো ভাইরাল শব্দটিই একটি ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে যেমন শুধু পপুলার বা বিখ্যাত হওয়ার জন্য নিজেই ভাইরাল হওয়ার চেষ্টায় থাকেন। কেউ ভাইরাল হচ্ছেন নিজেই, কেউ হচ্ছেন অন্যের ফাঁদে পড়ে। ভাইরাল শব্দটির এখন হাজার রূপ। এর যেমন খারাপ দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভালো দিকও। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বিষয় “ভাইরাল” হলে এটি সমাজের একটি বড় অংশকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার মুলকান্দি দশখাদা চরের মৃত মল্লিক শেখের স্ত্রী ছুরাতুল বেওয়ার কথা। মামুন বিশ্বাস নামের এক মানবতার ফেরিওয়ালা তার খোঁজ পেয়ে তার অবস্থার কথা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সহায়তার আবেদন করেন। সেই ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে ছুরাতুল বেওয়ার সহায়তায় এগিয়ে আসেন অনেকে।
একইভাবে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার আধুরপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ আবদুস সাত্তারের কথা মনে আছে অনেকের। খোলা আকাশের নীচে মানবেতন জীবনযাপনের সংবাদ ফেসবুকে পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুস সাত্তারের ভেঙে যাওয়া ঘরটি মেরামত করে দেন। এছাড়া ফেসবুকের কল্যাণে যশোরের বেনাপোলে দীর্ঘ আট মাস খোলা আকাশের নিচে কাঁকড়া ও শালুক ফল খেয়ে বেঁচে থাকা মনিকা নামের সেই বৃদ্ধার থাকার আসবাবপত্রসহ একটি ঘর প্রদান করেছিলেন দেশসেরা উদ্ভাবক মিজানুর রহমান।
আমরা প্রত্যেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে প্রতিনিয়ত নিজের একেকটি পার্সোনালিটি তুলে ধরার চেষ্টা করি। সবাই যে যার জায়গা থেকে নিজেকে ফোকাস করার চেষ্টা করি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষ তার নিজস্ব ভালো লাগার জিনিস, নিজস্ব রুচিমতো বিষয়গুলোয় শেয়ার করি। আর নির্দিষ্ট ধরনের মানুষ যখন তার পছন্দমতো (মনে ধরে) কনটেন্ট সামনে পায় তাই-ই শেয়ার করা শুরু করে। ফলে “ভাইরাল” হয় ওই ধরনের বিষয়গুলো।
মানুষের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো অন্যকে ফলো করা বা ট্রেন্ড ফলো করা। একজন কিছু করেছে দেখলে, সেটা অন্যজনও কারণে বা অকারণে অন্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য হলেও সেটি করে ফেলে। বিভিন্ন সময় চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে এমন অনেক মানুষকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য বা মতামত প্রকাশ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে ইতিবাচক বিষয় সবাইকে আগ্রহী করে তোলে।
আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ৩৮ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী নিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে দশম স্থানে অবস্থান বাংলাদেশে সোশ্যাল-মিডিয়া তথা ফেসবুকের জোয়ারের সুস্পষ্ট প্রতিফলন। কিন্তু ব্যবহারের গুণগতমানের চিত্র মোটেও আত্মতুষ্টিদায়ক নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক ব্যবহার করে যেমন পরিবেশ রক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধাচারণ, নারী-নির্যাতনের প্রতিবাদ, নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসার নব-নব দ্বার উন্মোচন হচ্ছে। তেমনি মহামারী “করোনা” দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখা সম্ভব।
সেক্ষেত্রে মহামারী করোনার ক্ষতিকর দিক, পরিত্রাণের উপায়, সুরক্ষায় করণীয় বিষয়গুলো যদি “ভাইরাল” করা যায় তাহলে হয়তো-বা আমরাও রক্ষা পেতে পারি মহামারী এই করোনা ভাইরাস থেকে।
তাই সকলকে আহবান জানাবো আসুন “করোনা” ভাইরাল করি। নিজে বাঁচি, অপরকে বাঁচাই।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।