তন্ত্র-মন্ত্র দিয়ে নিজেদের প্রতি পাতাদের আকৃষ্ট করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করলেন ১৩জন মন্ত্রী এবং ৫জন পাতা। হাজার-হাজার দর্শকদের মাঝে খেলোয়াড়দের মনোমুগ্ধকর মন্ত্র সাধনার মাধ্যমে এমন খেলা সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। সেই সাথে মাঠের চারপাশে দর্শকদের মাঝে সাংস্কৃতিক উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। ঠিক এমনই খেলা হয়ে গেল শনিবার বিকেলে নওগাঁর পত্মীতলা উপজেলার আকবরপুর ইউনিয়নের উষ্টি বিএস উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে । বেসরকারি স্বেচ্ছাব্রতি সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্টে এর অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট ছাত্র সংগঠন ইয়ূথ এন্ডিং হাঙ্গার আকবরপুর ইউনিয়ন এবং পতœীতলা উপজেলা ফোরামের আয়োজনে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী বিলুপ্ত প্রায় পাতা খেলাটির আয়োজন করে।
পাতা খেলা কি : খেলাটিকে মূলত বলা হয়ে থাকে পাতা খেলা বা হাত খেলা। এটি এক ধরনের বø্যাক ম্যাজিকের চর্চার অংশ নির্ভর খেলা বলা হয়ে থাকে। তাই অনেকের কাছে তন্ত্র-মন্ত্রের পাতা খেলা নামেও পরিচিত। আবহমানকাল বাংলার গ্রাম অ লে এখনো এই খেলাটি আয়োজন করা হয়। তবে সময়েরর বির্বতনে খুব বেশি দেখা যায়না এই খেলা আগের মত। মূলত যে ওঝা ও কবিরাজ মন্ত্রের সাহায্যে বেশি পাতা দাগের বাহিরে নিয়ে আসবে ও বশ করতে পারবে সেই ওঝা বা কবিরাজ জয়লাভ করবে অন্যদিকে যে পাতা ওঝার মন্ত্রে নিজেকে স্থির রেখে দাগের ভিতরে থাকবে তাকেও বিজয়ী বলে ষোষনা করা হয়ে থাকে।
শুরু হয়ে গেল তন্ত্র-মন্ত্রের পাতা খেলা: তখন বিকেল ঠিক ৪টা। নওগাঁর পতœীতলা উপজেলার উষ্টি বিএস উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে চারপাশে প্রায় ৪হাজার এর মত দর্শক। দর্শকের কড়তালির মধ্যে দিয়ে শুরু হয় খেলাটি, এতে উৎসাহ ও উদ্দিপনার মধ্যে দিয়ে অংশগ্রহণকারীরা শুরু করেন খেলা। জেলার বিভিন্ন স্থান এসেছেন অংশগ্রহনকারী দল ও দর্শকরা। পাতা খেলায় সুসজ্জিত মাঠে ১৩জন ওঝা তান্ত্রিক এবং পাতা হিসেবে ৫জন অংগ্রহন করেন, তন্ত্রমন্ত্র মন্ত্রী বা তান্ত্রিক হিসেবে অংশ গ্রহন করেন নজরুল ইসলাম, সারোয়ার হোসেন, বেলাল হোসেন, আকবর আলী, রতন আলী, লুৎফর রহমান, খাদেমুল ইসলাম, সেকেন্দার আলী, মাহাবুর রহমান, সোলাইমান আলী, জুয়েল রানা, লাবিব হাসান, এবং নুরুল ইসলাম। অন্যদিকে পাতা হিসেবে অশং গ্রহন করেন, আব্দুল খালেক, আতোয়ার হোসেন, সবুজ হোসেন, লোকমান আলী এবং শাহাজান আলী।
মাঠের মধ্যে চলছে খেলা। মাঝখানে একটি কলাগাছ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। কলাগাছের গোড়ায় পানিভর্তি মাটির ঘটি। আর চারপাশ চুন দিয়ে বৃত্তাকারে ঘিরে দেয়া। বৃত্তাকারে চিহ্নিত করা হয়েছে গোটা মাঠটিকে। সবাই প্রথমে মাটির ঘটির পানিতে হাত ভেজালো। তার পর মাঠের বিভিন্ন পাশে খেলোয়াররা অবস্থান নিয়ে মাটিতে হাত রেখে মন্ত্র পড়তে লাগলো। কেউ মন্ত্র পড়ে হাত চাপড়ে শব্দ করছে। কেউবা আবার কাঁপতে কাঁপতে চিলের মতো তাও মারছে। লক্ষ্য যে ওঝা ও কবিরাজ মন্ত্রের সাহায্যে বেশি পাতা দাগের বাহিরে নিয়ে আসবে ও বশ করতে পারবে সেই ওঝা বা কবিরাজ জয়লাভ করবে। মন্ত্রের শক্তিতে কেউ চিটপটাং হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। ‘দুই চোখে দেখাদেখি, চার চোখে টানাটানি, সপ্ত চোখে বস,ওরে বম। আমাকে ছাড়িয়া যদি অন্যদিকে যাস, দোহাই তোর-মহাদেব, দোহাই তোর- ঈশ্বরের মাথা খাস।’ এমন সব মন্ত্র পড়ে পাতাদের পরাস্ত করার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে মাঠের মধ্যে থাকা ৫জন পাতা মাটিতে হাত রেখে অবস্থান নেয় মাঠের বিভিন্ন স্থানে। তাদেরও লক্ষ্য যাতে তান্ত্রিক বা ওঝাদের মন্ত্রে পরাস্থ না হয়ে মনস্থির ঠিক রাখা। এরই মধ্যে জমে ওঠে পাতা খেলা। দর্শকদের মুখে মুখে হাসি। হাতে হাতে করতালি। টান টান উত্তেজনা চলছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় প্রায়। যে সব ওঝা বা তান্ত্রিক তাদের মন্ত্র বা বানে পাতাদের পরাস্ত করতে পারে তাদের জয়ী হিসেবে ঘোষনা করা হয়। অন্যদিকে যে সব পাতারা তান্ত্রিক মন্ত্রের শক্তি থেকে নিজেদের আত্বরক্ষা করতে পেরেছে তাদের বিজয়ী বলে ঘোষনা করা হয়। টানা প্রায় ২ঘন্টা পর শেষ হয় তন্ত্র-মন্ত্রের পাতা খেলা।
কারা হলেন জয়ী : স্থানীয় উষ্টি গ্রামের সেকেন্দার আলীর পরিচালনায় খেলায় মহাদেবপুর উপজেলার নজরুল ইসলাম ২টি পাতা টেনে চ্যাম্পিয়ান খেতাব অর্জন করেন। আর রানার আপ ৩টি দল প্রত্যেকে ১টি করে পাতা টানতে সক্ষম হন। তারা হলেন পতœীতলা উপজেলার মাটিন্দর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের সারোয়ার হোসেন, আকবরপুর ইউনিয়নের বড়মহারন্দি গ্রামের সেকেন্দার আলী এবং মধইল গ্রামের মাহাবুর রহমান।
কি পুরুষ্কার পেলেন অংশগ্রহনকারীরা : খেলা শেষে প্রত্যেক পাতাকে গামছা, সাবান এবং নারিকেল প্রদান করা হয়। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক মন্ত্রীকে নারিকেল এবং চ্যাম্পিয়ান ও রানার আপ মন্ত্রীদের এলাকার ঐতিহ্য মেনে এক ডজন করে নারিকেল পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়। তবে অংশগ্রহনকারী সবাইকে সন্মানিত করে বিশেষ পরুষ্কার দেয়া হয়।
অংশগ্রহনকারীদের অভিব্যক্তি : তান্ত্রিক হিসেবে অংশ গ্রহনকারী নজরুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১৫বছর থেকে এই খেলা খেলছি। শুধু নওগাঁ নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে খেলে আসছি। এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে । তাই আগের মত আর বেশি খেলতে পারিনা। আর তেমন বেশি আয়োজন করা হয়না আগের মতন এই তন্ত্র-মন্ত্রের পাতা খেলা। এই মন্ত্রে বা বানে কি পাতা পক্ষের অংশগ্রহনকারীদের কোন সমস্যা হয়কি পরবর্তীতে তাদের শারীরিক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্র বা বাণ দিলে সেই বানটি আবার ফেরত আনা যায় যদি বাণ ফেরত নিতে না যায় তাহলে আবার কিসের খেলা হলো। এতে কারো কোন ক্ষতি হয়না।
পাতা হিসেবে অংশগ্রহনকারী আব্দুল খালেক জানান, এটি অনেক পুরাতন একটি খেলা। এই খেলায় পাতা হিসেবে মনস্ত্রিরটা ঠিক রাখতে হয়। ওঝা বা তান্ত্রিকরা যখন মন্ত্র পড়ে বসে আনতে চায় তখন নিজের মনস্ত্রিরটা স্বাভাবিক রাখতে হয়। তবে খুব কঠিন হয়ে যায় মনস্ত্রির ঠিক রাখা। অনেকদিন পর এমন খেলায় অংশগ্রহন করতে পেরে ভালো লেখেছে।
আয়োজনটি নিয়ে আয়োজকরা যা বললেন: আয়োজকদের পক্ষ থেকে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের পত্মীতলা এলাকা সমন্বয়কারী আসির উদ্দীন বলেন, সাংস্কৃতিক উন্মাদনা তৈরি গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী ধরতে রাখতেই এমন আয়োজন আমাদের। আমরা চাই সামাজিক স¤প্রীতি অটুট রাখতে সহনশীলতার চর্চা অব্যাহত থাকুক। আগামীতেও এমন আয়োজন আবারও করা হবে বলে আশা করছি।
আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ জেলা পরিষদ সদস্য ফাতেমা জিন্নাহ ঝরণা, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পত্মীতলা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ রাহাত ও খাদিজাতুল কোবরা মুক্তা, আকবরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মহাতাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ি সাহেব আলী, পত্মীতলা উপজেলা গণগবেষণা ফোরামের সভাপতি শাহীনুর রহমান, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রশিক্ষণ বিভাগের তুহিন আফসারী ও সোহেল রানা, এলাকা সমন্বয়কারী আসির উদ্দীন এবং ইয়ূথ এন্ডিং হাঙ্গারের পত্মীতলা উপজেলা ফোরাম সমন্বয়কারী মোস্তাকিম হোসেন, সম্পাদক শাহরিয়ার শাকিল, কোষাধ্যক্ষ তসিবা পারভীন নিশি, রনি ইসলাম এবং ইউনিয়ন সমন্বয়কারী হারুনুর রশিদ প্রমূখ।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।