রমজানের শেষ দশকের আমল, তাৎপর্য ও বিধান

নিজস্ব প্রতিবেদক
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী- বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ
প্রকাশিত: শুক্রবার ২১শে মার্চ ২০২৫ ১১:০৯ পূর্বাহ্ন
রমজানের শেষ দশকের আমল, তাৎপর্য ও বিধান

পবিত্র রমজান মাস মুসলিমদের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এই মাসের শেষ দশক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী ‘লাইলাতুল কদর’। রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে বিশেষ ইবাদত ও আমলে মশগুল হতেন। এই দশকের আমল, তাৎপর্য ও বিধান সম্পর্কে কিছু আলোচনা নিচে তুলে ধরা হলো।  


লাইলাতুল কদরের ফজিলত: রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের ইবাদত থেকেও উত্তম। এই রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে এবং এতে রয়েছে অসংখ্য বরকত ও কল্যাণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি (কুরআন) নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কী জানাবে লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সূরা কদর: ১-৩)। এই রাতে ইবাদত করলে অতীতের গুনাহ মাফ হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারী ও মুসলিম)।  


রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমল: রমজানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইবাদতে অধিক মশগুল হতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক এলে রাসূলুল্লাহ (সা.) রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারকে জাগাতেন এবং ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)। তিনি এই দশকে স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন এবং মসজিদে এতেকাফ করতেন। এতেকাফের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতেন।  


এতেকাফের গুরুত্ব: এতেকাফ হলো মসজিদে অবস্থান করে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া। এটি রমজানের শেষ দশকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)। এতেকাফের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে দুনিয়ার সব কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু আল্লাহর ইবাদতে মশগুল করে। এটি আত্মশুদ্ধি ও ঈমান বৃদ্ধির একটি উত্তম মাধ্যম।  


লাইলাতুল কদরে করণীয়: এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত, দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির করা উচিত। হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘লাইলাতুল কদরে আমি কী দোয়া করব?’ তিনি বললেন, ‘তুমি বলবে: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরমিযী)। এই রাতে দোয়া কবুল হয় এবং ফেরেশতারা রহমত নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন।  


রমজানের শেষ দশকের আমল: এই দশকে বেশি বেশি ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকির করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দশকে তাহাজ্জুদ, জিকির ও দোয়ায় বেশি সময় ব্যয় করতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দশকে এত পরিশ্রম করতেন যা অন্য সময় করতেন না।’ (মুসলিম)।  


এতেকাফের বিধান: এতেকাফের জন্য মসজিদে অবস্থান করা জরুরি। পুরুষরা মসজিদে এতেকাফ করবে, আর মহিলারা ঘরে নির্দিষ্ট স্থানে এতেকাফ করতে পারবে। এতেকাফকারীর জন্য প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া নিষেধ। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হলো সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাজায় উপস্থিত হবে না এবং স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করবে না।’ (আবু দাউদ)।  


এতেকাফের উদ্দেশ্য: এতেকাফের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা এবং লাইলাতুল কদর তালাশ করা। এটি আত্মশুদ্ধি ও ঈমান বৃদ্ধির একটি উত্তম পদ্ধতি। এতেকাফের মাধ্যমে বান্দা দুনিয়ার সব কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়।  


রমজানের শেষ দশকের তাৎপর্য: এই দশক মুসলিমদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে লাইলাতুল কদর রয়েছে। এই রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত থেকেও উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দশকে বেশি বেশি ইবাদত করতেন এবং উম্মতকেও এতে উৎসাহিত করতেন।  


মুসলিমদের উচিত রমজানের শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদত করা, কুরআন তিলাওয়াত করা এবং দোয়া করা। এই দশকের আমল ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মহান ইবাদতের তাওফিক দান করুন। আমিন।  


লেখক: হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট।