আখেরি চাহার সোম্বা কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৭ই অক্টোবর ২০২১ ০৯:৫০ পূর্বাহ্ন
আখেরি চাহার সোম্বা কী?

আখেরি চাহর শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সি বাক্য। প্রথম শব্দ ‘আখেরি’ আরবি ও ফার্সিতে পাওয়া যায়। যার অর্থ হলো- শেষ। ফার্সি ‘চাহর’ শব্দের অর্থ হলো- সফর মাস এবং ফার্সি ‘শোম্বা’ শব্দের অর্থ হলো- বুধবার। অর্থাৎ ‘আখেরি চাহর সোম্বা’র অর্থ দাঁড়ায়- সফর মাসের শেষ বুধবার। দিনটিকে মুসলিম উম্মাহ খুশির দিন হিসেবে জানে এবং খুশির দিন হিসেবেই উদযাপন করে থাকে। কিন্তু কেন?


আখেরি চাহার সোম্বা উদযাপন


সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ অসুস্থতার পর সাময়িক সুস্থ হয়ে ওঠার দিনকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে ইবাদত ও উৎসব প্রচলিত তাই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি উদ্যোগে এ উৎসব-ইবাদত যথাযথ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করে থাকেন।


পারসিক প্রভাবিত অঞ্চলসহ ভারতীয় উপমহাদেশের দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বহু যুগ ধরে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলের সুফি-সাধকসহ দিল্লি সালতানাতের শাসকবর্গ রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই আখেরি চাহার সোম্বা পালন করতেন।


তবে বিশ্বব্যাপী দিনটি একযোগে যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার কারণে বর্তমান সময়ে অনেকেই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ উদযাপন ও তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাদের দাবি, আখেরি চাহার সোম্বা পালনের বিষয়ে হাদিসের কোনো দলিল নেই কিংবা পরবর্তী সময়ে সাহাবায়ে কেরামও এ দিনটি খুশির দিন হিসেবে উদযাপন করেছেন বা প্রতি বছর দান-সাদকা করেছেন এমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।তাই অনেকেই মনে করেন যে, যেহেতু সাহাবায়ে কেরামদের যুগ ও পরবর্তী সময়ে তা ছিল না, সে হিসাবে আখেরি চাহার সোম্বা ঘটা করে পালনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।


তবে পৃথিবীর সব অঞ্চলের মুসলমানরা যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে দিনটি পালন না করলেও উপমহাদেশের অনেকে এ দিনটিতে ইবাদত করে অথবা দান-খয়রাত করেন। তাই অনেকে মনে করেন, উপলক্ষ যা-ই হোক, আখেরি চাহার সোম্বা উপলক্ষে যদি কেউ নফল নামাজ পড়েন, আল্লাহর নামে গরিব-দুঃখীর মাঝে দান-খয়রাত করেন, তাতে ব্যক্তি ও সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হওয়া ছাড়া অকল্যাণের কিছু আছে বলে মনে হয় না।  তাতে দোষের কিছু নেই। কারণ, দানে-ইবাদতে মানুষ পরিশুদ্ধ হয়। সম্পদ বাড়ে।


আখেরি চাহার সোম্বা কী?


প্রকৃত সত্য হচ্ছে যে, সফর মাসের শেষ বুধবার হচ্ছে, ‘আখেরি চাহার সোম্বা’। এটা কী? তা অনেকেই জানেন না। এ সম্পর্কে সিরাত গ্রন্থ থেকে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাহলো-


সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, সফর মাসের শেষ দিকে কিংবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরুর দিকে হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার অন্তিমযাত্রার অসুখ হয়। ওই সময়ে এক মধ্যরাতে তিনি গিয়েছিলেন বাকিউল গারকাদ (জান্নাতুল বাকি) কবরস্থানে। সেখানে মৃত ব্যক্তিদের জন্য তিনি মোনজাত করেন। শেষ রাতে ঘরে ফিরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওই অসুখ যে তার মৃত্যুযাত্রার সূচনা ছিল, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।


হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার মুক্ত ক্রীতদাস হিবার কথোপকথন থেকেও বিষয়টি সুস্পষ্ট। মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মধ্যরাতে বাকিউল গারকাদ কবরস্থানে যান, তখন হিবাও সেখানে গিয়েছিলেন। হিবা বলেন, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে দেখে বললেন, ‘আমাকে দুটো বিকল্পের একটি পছন্দ করতে বলা হয়েছে-


১. এই জগতের সব সম্পদের ধণভান্ডারের চাবি ও দীর্ঘজীবন অথবা


২. বেহেশত, আমার আল্লাহর দিদার এবং তাৎক্ষণিক বেহেশত।’


হিবা বলেন, ‘আমি বললাম, আপনি প্রথমটি পছন্দ করেন।’


তিনি বললেন, ‘আমি দ্বিতীয়টি পছন্দ করেছি।’ অর্থাৎ মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াকে বিদায় জানিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভকে বেছে নিয়েছেন। আর এরই পরিপেক্ষিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ওই অসুখে তার জীবনাবসান হবে, তা তার অজানা ছিল না।


এ অসুস্থতায় আবিসিনিয়া থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানো হলেও তাঁর অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি কিছুক্ষণ ভালো থাকলেও পরবর্তী মুহূর্তেই তিনি জ্ঞান হারাতেন। এ অবস্থায় নবি পরিবারের সদস্য ও সাহাবিরা তার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন।


ওই নিরাশার মধ্যেই একদিন তিনি আশার আলো জ্বালালেন। এক সকালে তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন। অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। সাত কুয়ার পানি দিয়ে তিনি গোসল করেন। হজরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং দুই নাতি হাসান  ও হোসেন রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খান।


প্রিয় নবির সুস্থ হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্য ও সাহাবিরা আনন্দে আত্মহারা হন। খুশিতে তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নফল নামাজ আদায় করেন। আল্লাহর নামে গরিব-দুঃখীর মাঝে সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করেন।


বর্ণিত আছে যে, এই খুশিতে সাহাবাদের মধ্যে- হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পাঁচ হাজার, হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সাত হাজার, হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু তিন হাজার দিরহাম এবং হজরত আবদুর রহমান বিন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু ১০০ উট দান করেন।


হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার এক বর্ণনা থেকেও জানা যায় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠেন। যদিও দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন।প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওই ঘটনাকে অঞ্চলভেদে কিছু মুসলিম প্রতিবছর স্মরণ করেন। সফর মাসের শেষ বুধবার বিশ্বনবি সুস্থ হয়ে ওঠেছেন বিধায় পারসিক মুসলিমরা এর নামকরণ করেন ‘আখেরি চাহার সোম্বা’।


বিশ্বনবির অুস্থতা কী ছিল?


আখেরি চাহার সোম্বার আগে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অসুস্থতা ভোগ করেছিলেন তা নিয়ে দুইটি বিবরণ পাওয়া যায়-


১. ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকিউল গারকাদ কবরস্থান থেকে ফিরে প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হন।


২. ইবনে হিশামের বর্ণনা মতে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার অন্তিমযাত্রায় প্রচণ্ড মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন।


মূলত প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণেই হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসহ্য মাথাব্যথা অনুভব করেন। ওই মাথাব্যথা এতটা মারাত্মক ছিল যে, তিনি তার অন্তিমযাত্রার অধিকাংশ সময় অজ্ঞান ছিলেন। কখনও একটু সুস্থ হলেও আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।


আখেরি চাহার সোম্বা পালন করতেই হবে এমনটি নয়; তবে এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই। তাছাড়া প্রত্যেক আরবি মাসেই রয়েছে সুন্নাত ইবাদতের দিকনির্দেশনা। আবার আছে সাপ্তাহিক ইবাদতের দিকনির্দেশনা। যা পালনে রয়েছে অনেক মর্যাদা ও সাওয়াব। যেমন-প্রত্যেক সপ্তাহে জুমআর দিনের ইবাদত। সোম ও বৃহস্পতিবারে রোজা পালন। আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়মিত আমল ছিল প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে নফল রোজা রাখা। যাকে আইয়ামে বিজের রোজা বলা হয়ে থাকে।


সুতরাং সফর মাসের বিশেষ কোনো ঘটনা বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ মতভেদ না করাই উত্তম। হাদিসের অনুসরণ ও অনুকরণে নেক আমল ও ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত করলেই মিলবে অনেক সাওয়াব।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি অন্যায় কাজ থেকে ফিরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।