দিল্লিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:৫৯ পূর্বাহ্ন
দিল্লিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধী ও সমর্থকদের সংঘর্ষে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মৃত্যুর মিছিল কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। গতকাল বুধবার সেখানে আরো ১৪ জন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা ২৭ জনে দাঁড়াল। আহত মানুষের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। সংঘর্ষকালে ১০৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি রাখা হয়েছে। সহিংসতার ঘটনায় দিল্লি পুলিশ গতকাল ১৮টি এফআইআর (এফআইআর) দাখিল করেছে। সংঘাতকবলিত এলাকাগুলোয় গতকাল দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুই দিনের ভারত সফরকালে সিএএর সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে তুঙ্গে ওঠা ওই সংঘর্ষ নিয়ে গত কয়েক দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মৌন থাকলেও গতকাল তিনি মুখ খোলেন। টুইটারে বিবৃতি দিয়ে তিনি শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে দিল্লিতে শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ব্যর্থ হয়েছেন—এমন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী। আর পুলিশকে ব্যর্থ উল্লেখ করে অবিলম্বে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। পুলিশকে তিরস্কার করেছেন সুপ্রিম কোর্টও। এ ছাড়া উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) চার নেতার বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

চির বৈরী পাকিস্তান থেকেও আসতে শুরু করেছে তিরস্কারের বাণ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতে থাকা ২০ কোটি মুসলিমকে রক্ষায় গোটা বিশ্বকে এবার এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিতর্কিত সিএএ নিয়ে গোটা ভারতে দুই মাস ধরে চলা অস্থিরতা রাজধানী দিল্লিতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ওই অস্থিরতা বেশ কিছুদিন ধরে শাহিনবাগের অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও গত শনিবার থেকে তা দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওই দিন রাতে দিল্লির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জাফরাবাদ থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলেও তখন, এমনকি পরদিন রবিবারও কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

গত সোমবার এক পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। সেদিন সাতজন, পরদিন মঙ্গলবার ছয়জন এবং সব শেষ গতকাল আরো ১৪ জন নিহতের খাতায় নাম লেখায়। এর মধ্যে গতকাল চাঁদবাগের এক নর্দমায় মেলে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) একজন কর্মকর্তার লাশ। ধারণা করা হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে ও মারধরের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও চলছে সমানতালে। গতকাল ভোররাত ৪টা থেকে নতুন করে পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয় ব্রহ্মপুরী-মুস্তাফাবাদ এলাকায়। গোকুলপুরীতে একটি পুরনো জিনিসপত্রের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এদিন জোহরিপুরায় ফ্ল্যাগমার্চ করে পুলিশ। গোকুলপুরীর ভাগীরথী বিহার এলাকায় ফ্ল্যাগমার্চ করে সিআরপিএফ, এসএসবি, সিআইএসএফ এবং পুলিশের যৌথ বাহিনী। সিলামপুর, জাফরাবাদ, মৌজপুর, গোকুলপুরীতে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে।

এর আগে গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করে সাধারণ মানুষ, যাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ও জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহ্বানে এ বিক্ষোভ হয়। দিল্লিতে চলমান সহিংসতা রোধে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে তারা কেজরিওয়ালের বাসবভনের সামনে বিক্ষোভ করে।

এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে এ বাহিনীকে তিরস্কার করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। দিল্লি পুলিশের পেশাদারির অভাব রয়েছে—এমন মন্তব্য করার পাশাপাশি পুলিশ যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, সেটাও উল্লেখ করেন বিচারক। শাহিনবাগে সিএএবিরোধী অবস্থান কর্মসূচি পালনকারীদের সরানোর জন্য জমা পড়া আবেদনের শুনানির সময় গতকাল পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন আদালত।

দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তবে তাতে সন্তুষ্ট নন বিরোধী নেত্রী সোনিয়া। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গোটা কেন্দ্রীয় সরকারই এর জন্য দায়ী। অমিত শাহ ইস্তফা দিন, এই দাবি করছে কংগ্রেস।’ কংগ্রেস নেত্রী আরো বলেন, ‘এই সংঘর্ষের পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। অনেক বিজেপি নেতা উসকানিমূলক মন্তব্য করে ভয় ও হিংসার পরিবেশ তৈরি করেছেন।’

সোনিয়ার এসব মন্তব্যের কিছুক্ষণের মধ্যে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, ‘কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক। এমন পরিস্থিতিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সব রাজনৈতিক দলের চেষ্টা করা উচিত। সেটা না করে উনি নোংরা রাজনীতি করছেন।’

মোদির টুইট: আতিথেয়তায় ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী মোদি গত কয়েক দিন অশান্ত দিল্লি নিয়ে টুঁ শব্দও করেননি। গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বিদায় জানিয়ে গতকাল দিল্লি নিয়ে সরব হন তিনি। এদিন তিনি টুইট করেন, ‘শান্তি ও সম্প্রীতি আমাদের সংস্কৃতির মূল কথা। দিল্লির ভাই-বোনেদের কাছে অনুরোধ, সর্বদা শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখুন। যত দ্রুত সম্ভব দিল্লিতে শান্তি এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসাটা জরুরি।’ টুইটারে তিনি আরো জানিয়েছেন, দিল্লির বিভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন তিনি।

সেনা নামাতে কেজরিওয়ালের আহ্বান : দিল্লির সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে সেনা মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছেন কেজরিওয়াল। তিনি গতকাল এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে টুইট করেন, ‘সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ। মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফেরানো যায়নি। এবার সেনা নামানো উচিত। উচিত ক্ষতিগ্রস্ত সব জায়গায় অবিলম্বে কারফিউ জারি করা। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছি আমি।’

আগের দিন মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে কথা বলেন কেজরিওয়াল। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন।

উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিলে হাইকোর্টের নির্দেশ : গতকাল হাইকোর্ট পুলিশের উদ্দেশে স্পষ্ট বলেছেন, ‘সম্পত্তি ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় আপনারা এফআইআর (প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন) দায়ের করেছেন। এই সক্রিয়তা তাদের বিরুদ্ধে কেন দেখাননি যারা হিংসায় মদদ দিয়েছে। অপরাধের অস্তিত্ব স্বীকারে আপনাদের বাধা কোথায়? এখনই এফআইআর দায়ের করুন। যারা যারা বিদ্বেষমূলক মন্তব্যে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে।’ দিল্লিতে চলমান সহিংসতার নেপথ্যে কারা, এ প্রশ্নের বিহিত চেয়ে যে মামলা হয়েছে গতকাল সেই মামলার শুনানিতে এ নির্দেশ দেন আদালত।

এদিন আদালতে দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর একটি ভিডিও প্রকাশ এজলাসে দেখেন বিচারকরা। দিল্লিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আগে ওই ভিডিও ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, কপিল মিশ্র দিল্লি পুলিশকে হুমকি দিচ্ছেন, জাফরাবাদ আর চাঁদবাগ থেকে সিএএবিরোধীদের না সরালে ফল ভুগতে হবে। ওই ভিডিওর পাশাপাশি বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর, অভয় বার্মা ও পরবেশ বার্মার ভিডিওগুলোও দেখেন বিচারকরা। সেগুলো দেখার পর দিল্লির পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়েকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘এই ভিডিওগুলো অবিলম্বে পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে এফআইআর দায়ের করতে বলুন। এফআইআর দায়ের না করার ফল ভুগতে হবে কমিশনারকে।’
ইনিউজ ৭১/এম.আর