মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে ‘রণাঙ্গণ’ পত্রিকার সম্পাদক, বর্তমানে রংপুর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক দাবানল’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।বৃহস্পতিবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার ছোট ছেলে দৈনিক দাবানল এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক খন্দকার মোস্তফা সরওয়ার অনু। গত সোমবার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
বিকেল ৪ টায় প্রেসক্লাবে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। বাদ আসর কেরামতিয়া জামে মসজিদে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৮ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল ১৯৪৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের বুজরুক ঝালাই গ্রামে মা মাজেদা বেগমের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এলএমএফ (চিকিৎসক)ডা. মোজাম্মেল হক খন্দকার।
বাড়ির পাশের কোনাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মা-বাবার সঙ্গে রংপুরে বসবাস শুরু করেন তিনি। ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী ঐতিহ্যবাহী কৈলাশরঞ্জণ হাইস্কুলে। ১৯৬০ সালে কৈলাশরঞ্জণ স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে।তখন তার বাড়ন্ত যৌবন। যৌবনের শুরুতেই জড়িয়ে পড়েন নেতৃত্বে। জড়িয়ে পড়েন পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে। আর ক্যাম্পাসের বাইরে ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রংপুরের সেনপাড়ায় (বর্তমান সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) খেলাঘর আসর।
১৯৬৪ সালে তখনকার দিনের ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩ জন কেন্দ্রীয় নেতা আসেন রংপুরে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে। তখন তাদের আটক করে জেলে পাঠানো হয়। সেই সময় রংপুর জেলা ছাত্রশক্তির সাধারণ সম্পাদক তিনি। এই আটকের প্রতিবাদে পুরো জেলায় হরতাল ডাক দেন বাটুল। এ কারণে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। তিনি জেলবন্দি থাকেন ৬ মাস। পরে মুক্ত হন। ওই বছরেই কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। কিন্তু কারমাইকেল কলেজ সরকারি হওয়ার পর আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের কারণে তাকে কারমাইকেল কলেজ দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তিনি ভর্তি হন রংপুর সরকারি কলেজে।
১৯৬৫-৬৬ সালে রংপুর কলেজের জিএস নির্বাচিত হন তিনি। ছাত্র অবস্থাতেই জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক আন্দোলনে। তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেন রংপুর-দিনাজপুর মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। স্নাতক পাসের পর উচ্চ শিক্ষায় ব্রতী না হয়ে তিনি যোগদেন শ্রমিক সংগঠন সম্প্রসারণে। যুগপদ শ্রমিক আন্দোলনের কারণে ১৯৭০ সালে মার্শা ল’র সময় তার ৬ মাসের জেল হয়।এরই মাঝে ঘনিয়ে আসে ১৯৭১ সাল।
ওই বছরের ১২ মার্চ মজদুর ফেডারেশনের ব্যানারে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে শ্রমিক জনসভায় আনুষ্ঠনিকভাবে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সেখানে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেন বাটুল। সারাদেশে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনে মুখর হয়ে উঠে মানুষ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অবস্থা বেগতিক দেখে ঢাকায় খাদ্যশস্য মজুতের পরিকল্পনা নিয়ে উত্তরাঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে ঢাকায় মজুত করতে থাকে। এই অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ডাক দেন তৎকালীন রংপুর-দিনজাপুর মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল।
২৩ মার্চ স্থানীয় তেঁতুলতলায় (বর্তমানে শাপলা চত্বর) এক শ্রমিক সভায় শ্রমিকদের খাদ্যশস্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন বাটুল। ফলে পরদিন থেকে খাদ্যশস্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। এতে শাসকগোষ্ঠী বাটুলের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। এ অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতার কথা চিন্তা করে ২৬ মার্চ রাতে গঙ্গাচড়ার মহিপুর হয়ে তিস্তা পাড়ি দিয়ে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে যান বাটুল। পরে সেখান থেকে ২৭ মার্চ ভারতের কুচবিহারের দিনহাটার সিতাই বন্দরে চলে যান তিনি। সেখানে গিয়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামের একটি রাজনীতিক দলের শরণাপন্ন হয়ে তাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ওই এলাকার ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা কমল গুহ বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক নেতা অলি আহাদের শিক্ষা জীবনের সহপাঠি ছিলেন। কমল গুহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাটুল সহযোগিতা কামনা করেন।
এ সময় কমল গুহ মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ ও সাহসে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ‘মুস্তফা করিম’ ছদ্মনামে সাপ্তাহিক ‘রণাঙ্গন’ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়।দেশ স্বাধীনের পর শুরু হয় রণাঙ্গনের সাহসী পথচলা। কিন্তু সেই সময়কার শাসকগোষ্ঠীর তোপের মুখে পড়ে রণাঙ্গন। সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা অফিসে হামলা চালিয়ে সব তছনছ করে দেয়। রণাঙ্গণ বাজেয়াপ্ত করে সরকার। পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনার অফিসে আপিল করে ছাপাখানাটি ফেরত পেলেও রণাঙ্গণের ডিক্লারেশন ফেরত পাননি তিনি। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাপ্তাহিক মহাকাল’। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রকাশনা অব্যাহত থাকে ‘সাপ্তাহিক মহাকাল’ এর। পাশাপাশি ১৯৮১ সালের ২৭ মে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দৈনিক দাবানল’।
বাটুল প্রতিষ্ঠিত এই তিনটি পত্রিকায় কাজ করেছেন দেশ বিদেশের প্রথিতযশা অনেক সাংবাদিক। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন, আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’র সাংবাদিক আব্দুল মালেক, রংপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক বায়ান্নর আলোর নির্বাহী সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মোনাব্বর হোসেন মনা, দৈনিক যুগের আলোর বার্তা সম্পাদক আবু তালেব, বিটিভির রংপুর প্রতিনিধি আলী আশরাফ, এটিএন বাংলার মাহবুবুল ইসলাম ও কেরামত উল্লাহ বিপ্লবসহ অসংখ্য গুণী সাংবাদিক দৈনিক দাবানলের অমর সৃষ্টি। এছাড়াও রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিদম্যান অধিকাংশ পত্রিকাগুলোও তারই হাতে গড়া সাংবদিকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে।
দৈনিক দাবানল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৯ সালে মিঠাপুকুর থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।শুধু সাংবাদিকতা, সম্পাদনা আর রাজনীতির মধ্যেই থেমে ছিলেন না বাটুল। মিঠাপুকুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে সেটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার হাতে গড়া সংগঠন মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন এখন উত্তরাঞ্চলে সব থেকে প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী সংগঠন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী সংগঠন রংপুর খেলাঘর, শিখা সংসদসহ অসংখ্য সংগঠন। সাংবাদিকতায় অনবদ্য অবদান রাখার জন্য রংপুর পৌরসভার সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড, রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাবের মোনাজাত উদ্দিন সাংবাদিকতা স্মৃতিপদকসহ অসংখ্য পদক পেয়েছেন তিনি।