ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিনাকাধীন শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (এসএফসিএল) ৪০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) নিজস্ব নিরীক্ষায় বিষয়টি ধরা পড়ার পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে এই জালিয়াতির নেপথ্যে তিন কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের দুজনকে ইতিমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন সহকারী হিসাবরক্ষক (হিসাব বিভাগীয় প্রধান) খন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন ও রসায়নবিদ নেসার উদ্দিন আহম্মেদ। পাশাপাশি সাবেক প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী কামরুজ্জামানের অবসরকালীন যাবতীয় সুবিধা স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। বিসিআইসির নিজস্ব অডিটে দেখা যায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও সাময়িক বরখাস্ত হওয়া দুই কর্মকর্তা ভুয়া বিল ভাউচারে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও এসএফসিএলে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে বড় ধরনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য বিসিআইসির নিজস্ব নিরীক্ষা অব্যাহত আছে।
ভুয়া বিল ভাউচারে ৪০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. হাইয়ুল কাইয়্যুম রবিবার বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। তারা আপিল করবেন, কোর্টে যাবেন, বিচার হবে তারপর বলা যাবে তারা আত্মসাৎ করেছেন কি না। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আমাদের কাছে মনে হয়েছে তারা দুর্নীতি করেছেন; আমরা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। তাছাড়া আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। আমরা বিধি মোতাবেক খন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন ও নেসার উদ্দিনকে বরখাস্ত (সাময়িক) করেছি। যিনি অবসরে গিয়েছেন তার অবসরকালীন সুবিধা স্থগিত রেখেছি।’
সারকারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে ২০১২ সালের শুরুতে ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। পরে ৪০৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ৫ হাজার ৮১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। দৈনিক ১৭৬০ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সর্ববৃহৎ ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী একটি সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন শুরু হয় ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। নির্মাণের পর বিভিন্ন কেনাকাটা, সংস্কার ও মেরামত কাজের ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে এসএফসিএলে ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাতের একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারা ওই অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে এসএফসিএলের হিসাব বিভাগীয় প্রধান খন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন ও রসায়নবিদ নেসার উদ্দিন আহম্মেদকে গত নভেম্বর মাসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সেখানে দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোস্তফা বোরহান উদ্দিন আহম্মেদ বিল ভাউচার অনুমোদনকারী কর্মকর্তা, যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ দেওয়া ও বিভিন্ন মালামাল কেনার কথা বলা হয়েছে তাদের তালিকা তলব করেছেন। সেই অনুসন্ধান এখনো চলমান আছে।
বিসিআইসির প্রধান অডিট কর্মকর্তা সোহেল আহম্মদ তার কার্যালয়ে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব নিরীক্ষায় এসএফসিএলে বড় ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকার ব্যয়ের সঠিক নথিপত্র আমরা পাইনি। নিরীক্ষায় ওইসব বিল ভাউচার ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা বিসিআইসির চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছি। তারা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।’
বিসিআইসির অডিট বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএফসিএলে আরও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। সেটা আমরা নিরীক্ষা করছি। ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ওই আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকার কম নয় দাবি করে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বিভিন্ন কেনাকাটা, মেরামত ও সংস্কারের নামে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।’
বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ জাকির হোসাইন বলেন, ‘শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে প্রথমে ৫৪ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরও ৪০ কোটি টাকার অডিট আপত্তি আসার পর এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনের পর দুই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। এখন বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলাসহ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিসিআইসি সূত্রে জানা গেছে, এসএফসিএলে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সাজেদুল আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা ছিলেন এসএফসিএলের হিসাব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম আব্দুল বারিক ও বিসিআইসির উপপ্রধান হিসাবরক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে সাজেদুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি রবিবার বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি। এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় কী হবে সেটা কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন। চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার নেই।’ কমিটির সদস্য আবদুল বারিক বলেন, ‘যা বলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারব না।’
শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী কামরুজ্জামান গতকাল রবিবার বলেন, ‘আমি অবসরে গিয়েছি এক বছর আগে। আমি শুনেছি সেখানে কিছু বিল বাউচার হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার জন্য কোনোভাবেই আমি দায়ী নই। সেটা হিসাব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে খন্দকার মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলতে পারবেন। আর কোনো অনিয়ম বা অর্থ আত্মসাৎ করলে তারা করতে পারে। আমি কোনো অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না।’ অবসরকালীন সুবিধা স্থগিত রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কামরুজ্জামান বলেন, ‘এরকম আমিও শুনেছি। তবে আমি দেশের বাইরে থাকায় ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় সেটার খোঁজ নিতে পারিনি। আমি এটা নিয়ে অবশ্যই ফাইট করব। আমি কোনো দুর্নীতির প্রশ্রয় দেব না। আমি নিজেও চাই কেউ অর্থ আত্মসাৎ করলে তার শাস্তি হোক।’
খন্দকার ইকবাল হোসেন সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি দুর্নীতির টাকায় নামে-বেনামে বিপুল স্থাবর অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে তার ১১০০ বর্গফুটের ৬টি ফ্ল্যাট, চারটি চেইনশপ, বনশ্রীতে তিনটি ফ্ল্যাট, বাসাবো ও খিলগাঁওয়ে কয়েকটি ফ্ল্যাট, কাকরাইল ও মালিবাগে রেস্টুরেন্ট (ভাড়া দেওয়া) রয়েছে। গ্রামের বাড়ি ফেনীতেও রয়েছে বিপুল সম্পদ। এছাড়াও তার নামে-বেনামে ৪০টি গাড়ি বিভিন্ন রেন্টে কারে ভাড়া দেওয়া রয়েছে বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। ভুয়া বিলে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানার জন্য খন্দকার ইকবাল হোসেনের মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। কয়েক দিন আগে তার মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় গেলে বলা হয় তিনি জরুরি কাজে বাইরে আছেন।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।