ভোলার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার বাঘা সিদ্দিককে ভুলতে বসেছে সবাই। মুক্তিযুদ্ধে অদম্য সাহসিকতার জন্য সিদ্দিকুর রহমানকে তার সহ যোদ্ধারা বাঘা সিদ্দিক এবং কখনও হাই-কমান্ড সিদ্দিক নামে ডাকতো। মুঠোফোনে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি বা কোথায় আছি, কেমন আছি এ খবরটুকু নেয়ার মতো কেউ নেই।
সারা বছর না হোক অন্তত: স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসেতো একটু মনে পড়ার কথা। আমারতো চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার জন্মস্থানে স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবসের কত কত অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে কথা হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে। সেখানে আমি নেই, আমার নাম নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এক যুগের মধ্যে কারো যোগাযোগ মনে পড়ে না। কষ্ট এজন্য যে, ভোলার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছি আমি। এতো কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেখানে আমি অনুপস্থিত। হয়তো এখন আমার প্রয়োজন ফুড়িয়ে গেছে। আমি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। সময় বড় নির্মম। শেষ ফয়সালা সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
সিদ্দিকুর রহমান দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোলা-২ আসনের(তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-৪) সংসদ সদস্য ছিলেন। এখন ঢাকায় নিভৃত জীবন যাপন করছেন। মাঝে মাঝে বোরহানউদ্দিনের বাড়িতে আসলেও নিরবে চলে যান। সর্বশেষ এ বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে বোরহানউদ্দিন এসেছিলেন। বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুজ হয়ে পড়েছেন। প্রায় ছয়ফুট উচ্চতার ফিটফাট ক্লিন শেভড মানুষটার মুখে সাদা দাড়ি। হাতে তসবিহ। বাসায় কথা হয় তার সাথে। দেশের জন্য যে লক্ষ্যে জীবন বাজি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তার প্রতিফলন কি হয়েছে? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি একটি সমতা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, রাস্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরের দাড়প্রান্তে দাঁড়িয়ে এখনও তা অধরাই দেখছি।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোলা পাকিস্থানি হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালে ৬ মে ভোলার খেয়াঘাট দিয়ে এসে পাক বাহীনি ওয়াপদাকে মূল ক্যাম্প করে। পরবর্তীতে ওই স্থান থেকে ভোলা সদর সহ অন্যান্য থানা গুলোতে পাক বাহীনি ক্যাম্প স্থাপন করে। ভোলা সহ প্রতিটি থানায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা সহ ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল পাক-হানাদাররা। ভোলা সদর সহ বিভিন্ন থানায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিচ্ছিন্ন ভাবে তাদের হামলার জবাব দিচ্ছিলো।
সংগঠিত যুদ্ধ বলতে যা বুঝায় তার অনেকটাই ছিল অনুপস্থিত। সেনাবাহিনীতে কর্মরত বোরহানউদ্দিনের সন্তান সিদ্দিকুর রহমান সেনাবাহীনি থেকে পালিয়ে খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশালে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। ভোলার করেন অবস্থা বেগতিক দেখে ৯ নাম্বার সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল তাকে ভোলায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাঠান। সিদ্দিক ভোলায় এসে কাজী মোতাহার মাষ্টার, রেজা-এ-করিম চৌধুরী(চুন্নু মিয়া), রতন চৌধুরী, সাইফুল্লাহ জুলু, শশী, হোসেন চৌধুরী, কাজী আহতাব উদ্দিন, আলী আকবর, আজিজল মিয়া, হযরত আলী,আচমত মিয়া, আলতাফ রহমান, মাহবুব আলম মুন্সি, নাছির তালুকদার, গিয়াস তালুকদার, সহ অনেককে নিয়ে ভোলা হানাদার মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন।
ভোলা হানাদার মুক্তকরনে বোরহানউদ্দিনে ২২ অক্টোরব দেউলার যুদ্ধ এবং ২৭ অক্টোবর টনির হাট(ঘুইংঘার হাটের) যুদ্ধ সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত। দেউলার যুদ্ধে হাই কমান্ড ছিদ্দিকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী দখদার মুক্ত করে এ অ ল। ওই যুদ্ধে ৬৪ পাক হানাদার নিহত হয় এবং অনেককে বন্দি করা হয়।
টনির হাট যুদ্ধে প্রথমে হযরত আলী এবং আজিজল মিয়া পাকিস্থানিদের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে কিন্তু কাঙ্খিত লক্ষ্যে তারা পৌছতে পারছিল না। তখন ছিদ্দিক ও তার বাহিনী সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধে হানাদারদের পরাজিত করেন। ওই স্থানে ৫ পাক-হানাদার নিহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে অন্যরা ভোলায় পালিয়ে যায়। ওই দুই যুদ্ধে ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১০ ডিসেম্বর ভোলাবাসী মুক্তির আনন্দ মিছিলে শামিল হয়।
তথ্য সুত্র-ভোলা জেলার ইতিহাস- লেখক প্রফেসর হোসেন চৌধুরী ও সিদ্দিকুর রহমানের সাক্ষাৎকার)
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।