আজও আলোর মুখ দেখেনি জেল খাল প্রকল্প, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: সোমবার ২৯শে জুলাই ২০১৯ ১১:৩৬ অপরাহ্ন
আজও আলোর মুখ দেখেনি জেল খাল প্রকল্প, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

বরিশালের প্রাণখ্যাত ঐতিহ্যবাহী জেল খালটি আজও প্রাণ ফিরে পায়নি। দখলদারদের কবল থেকে খালটি মুক্ত করতে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সর্বকালের স্মতঃস্ফুর্ততার উদাহরন সৃষ্টি করে হাজার হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে ঐতিহ্যবাহি জেল খালটিতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। অভিযান কর্মসূচীতে অংশ নেন তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি, বরিশাল সদর আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ, বরিশাল-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য এ্যাড. শেখ মো: টিপু সুলতান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক, তৎকালীন সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামাল, সাবেক বরিশাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো: সাইফুজ্জামান, বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবুল কালাম আজাদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কাজী হোসনেয়ারা। এর সাথে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, তরুন-তরুনী ও স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, স্কাউট, বিএনসিসি, সাংস্কৃতিক সংগঠন  ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা।

এরপর থেকে শুধুই অপেক্ষা কবে আবার এ খালটি তার জৌবন ফিরে পাবে? প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও বরাদ্দ না পাওয়ায় খাল খনন কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী জেল খালসহ বরিশালের ২৩টি খাল পুনরায় দখল দূষণের আশংকা রয়েছে। অথচ তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামান ২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের আবেদন করেছিলেন বলে জানা যায়। আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক জানিয়েছিলেন, জেল খাল উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প শীঘ্রই পাস হবে। তবে ওই প্রকল্প আজও আলোর মুখ দেখেনি। তবে বরিশাল জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান জানিয়েছেন, জেলখালসহ নগরীর সবগুলো খাল নিয়েই একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে শীঘ্রই বরিশাল সবগুলো খান পুন:খনন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রকল্প কাজ শুরু হবে।

ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল, নদী ও খাল বরিশালের জিবন প্রবাহ। এই নদী ও খালের সমন্বয়ে নগরের সৌন্দর্য দেখে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বরিশালকে ‘প্রাচ্যের ভ্যানিস’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। নদী থেকে বড় ও ছোট ছোট খালের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও গঞ্জ সংযোজিত হয়েছে। এক কথায় বরিশাল নদ-নদী, খাল-দোন দ্বারা জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। এই খাল ও নদীতে নানাবিধ বজরা, কোষা ও নৌকায় যোগাযোগের মাধ্যমে বরিশালের মানুষ পন্য নিয়ে স্থানিয় হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জে চলাচল করতো। বরিশাল নগরের যেসব খাল দিয়ে যাত্রী ও পন্য পরিবহন হতো এর বেশ কয়েকটি ঘাটের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। 

সূত্রমতে, ৭০ দশকেও বরিশাল নগরের অভ্যন্তর দিয়ে ২২টি খালের প্রবাহের অস্তিত্ব ছিল। এ সকল খালের মাধ্যমে নগরের বিভিন্ন হাট বাজার পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা নদী, বাহেরচরনদীর সাথে সংযোগ হয়ে জোয়ার ভাটা প্রবাহিত হতো। কীর্তনখোলা নদীর উৎস থেকে বরিশাল শহরে প্রধানত আমানতগঞ্জ খাল, জেলখাল, ভাটারখাল, চাঁদমারিখাল, সাগরদীখাল ও পুডিয়াখাল সহ ৬টি খাল উৎসারিত হয়েছে। এই খালের শাখা ও উৎসে সৃষ্ট ২২টি খালের মাধ্যমে নগরের অভ্যন্তর দিয়ে এঁকে বেকেঁ প্রবাহিত হয়েছে। কীর্তনখোলা নদী থেকে সাগরদি খালের মাধ্যমে ভেদুরিয়া খাল, নাপিতখালী খাল, পুডিয়া খাল, টিয়াখালী খাল, জাগুয়া খাল ও হরিনাফুলিয়া খাল নগরের পশ্চিম ও উত্তর সিমানায় কালিজিরা সন্ধ্যা নদীর সাথে মিলে বানারিপাড়া ও উজিরপুরের সাথে নৌযোগাযোগ হতো। কীর্তনখোলা নদী অপর একটি প্রবাহ জেলখালের সাথে লাকুটিয়া খাল মিরগঞ্জ হয়ে বাহেরচর নদীর মাধ্যমে বাবুগঞ্জ সাথে সংযোজিত হয়েছে। এর অপর একটি শাখা নবগ্রাম খাল, কাশিপুর খাল, বাগিয়ার খাল, কলাডেমা খাল, কড়াপুর খালের সাথে মিলে বিভিন্ন গ্রাম ও গঞ্জে মিলেছে। কীর্তনখোলার অপর সংযোগ আমানতগঞ্জ খালের মাধ্যমে সাপানিয়া খাল, সোলনা খাল, লাকুটিয়া খালের মাধ্যমে নগরের অভ্যন্তর দিয়ে বাবুগঞ্জের বাহেরচর নদীর সাথে সংযোগ ছিল। এর মাধ্যমে দূরবর্তি মানুষের নগর ও গ্রামের যোগাযোগ হত। 

জানা যায়, স্বাধীনতা পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই খাল দিয়ে শহরের সাথে নৌপথে বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, বানারিপাড়া ও গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন বন্দর ও গ্রামের সাথে নিবির যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন প্রকার নৌকা ও ছোট লঞ্চ মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ ও মানুষের যাতায়াত ছিল। এই খালের পারে প্রায় ২২টি পাঁকা ঘাটলা ছিল যা থেকে এলাকার অধিকাংশ মানুষের গোসলসহ পরিবারের প্রয়োজনে পানি ব্যাবহার ও সংগ্রহ করতো। এই খালে জোয়া-ভাটার পানি দিয়ে উভয় পারে বিভিন্ন কৃষিকাজে ব্যাবহার হত। নানা জাতের মাছ উৎপন্ন হতো এবং এই মাছ ধরে একশ্রেনীর মানুষ জীবন ধারণ করতো। এই খালের সাথে অসংখ্য কাচাঁ ড্রেন ছিল এ থেকে প্রবাহিত পানি ও মাছ পার্শ্ববতী পুকুরে গিয়ে পড়ত। জেলখালের উপর দিয়ে উভয় পার্শের  মানুষ যোগাযোগের জন্য পোটরেড ব্রিজ, চকেরপোল, নাজিরেরপোল, জেলেবাড়ীপোল, মরকখোলার পোল, নতুল্লাবাদপোল ইত্যাদি রয়েছে। 

স্বাধীনতার পূর্ব এবং পরবর্তীতে এ খাল দিয়ে ছোট ছোট লঞ্চ , ট্রলার এবং গয়না নৌকা চলাচল করত। নাজিরপুল থেকে যাত্রী এবং মালামাল নিয়ে লঞ্চ , ট্রলার ও গয়না নৌকাগুলো সকালে, দুপুরে এবং বিকেলে ছেড়ে যেত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একইভাবে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে বানারীপাড়া, নাজিরপুর, উজিরপুর হয়ে বরিশাল আসত। বিপুল সংখ্যক যাত্রী চলাচল করতেন এই খাল দিয়ে। পরবর্তীতে কীর্তনখোলার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং জেল খালের উভয় পাড়ের সম্পত্তি বেদখল শুরু হলে খালের পানি প্রবাহ কমে যায়। এ সুযোগে গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জেল খালটি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায় এবং এক পর্যায়ে খালটির অনেকাংশেই ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে নথুলাবাদ ব্রীজের পর খালটিতে আর পানি প্রবাহ থাকে না বললেই চলে। আমাবস্যা বা পূর্নিমায় কিছুটা জোয়ার ভাটা হলেও পানি প্রবাহ থাকে কীর্তনখোলা নদী থেকে নথুলাবাদ ব্রীজ পর্যন্ত। 

দখলদারদের থাবায় মৃত প্রায় জনগুরুতপূর্ণ এ খালটি ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিলো জেলা প্রশাসন। তখন জেলা প্রশাসনের এ পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেশের সর্বত্র ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এছাড়া খালের উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন চাওয়া হয় স্থানীয় সরকার বিভাগে। তবে এখন পর্যন্ত ওই বরাদ্দ না পাওয়ায় খালের উন্নয়নকাজ দৃশ্যমান হচ্ছেনা। এদিকে দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় পুনরায় খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। কোন কোন স্থানে ময়লা স্তুপে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি খাল। তাছাড়া ঐতিহ্যবাহী জেল খাল ও রায়ের (লাকুটিয়া খাল) খালের কিছু কিছু অংশে ফের দখল উৎসবে মেতে উঠছে দখলকারীরা। সচেতন নগরবাসীর দাবি খালটির উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হোক। নদী খাল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় খালের উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা বিষয়টি তুলে ধরেছি। বরিশালের জনগণ জেলখাল সহ সকল খাল উদ্ধারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে যা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অবগত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কার্যত খালগুলো দীর্ঘদিন ধরে কোন সংস্কার করা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও এর কোন উন্নয়ন ঘটছে না। অথচ বাংলাদেশের ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় খাল খনন কর্মসূচি অব্যাহত আছে এবং সরকার তাতে বড় ধরণের বরাদ্দ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাদারীপুরে খাল খননে ৯০ কোটি টাকার প্রকল্প দেয়া হয়েছে কিন্তু আমাদের বরিশালে এখনো কোন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে ছোট ছোট প্রকল্প হলে কিছুটা কাজে আসতো। তবে যেহেতু বড় প্রকল্প হাতে নেয়ায় এটা স্থিমিত হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি। যে জনগণকে আমরা উদ্ধুদ্ধ করেছিলাম তারা এখন হতাশ। বর্ষা গেলেই শুকনো মৌসুমে খালগুলো শুকিয়ে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে বরিশালবাসীর জনস্বাস্থ্য একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে বলে আশংকা করছি। তাই এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন বা জেলা প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট সকল দফরের উচিত বিষয়টি সরকারের নজরে এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জানান, জেলখাল সহ ২২টি খালের উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে। খুব শীঘ্রই জেল খালসহ সকল খালই একযোগে খনন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কাজ শুরু হবে।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব