ছেলে ধরা সন্দেহে দেশের নয় জেলায় ৩০ জনকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কুষ্টিয়ায় ছয়, রাজশাহীতে পাঁচ, বগুড়ায় চার, নীলফামারীতে চার, কুমিল্লায় চার, চট্টগ্রামে তিন, সাভারে দুই, মাদারীপুর ও নেত্রকোনায় একজন করে আহত হয়েছেন। পিটুনি থেকে রেহাই পাচ্ছে না মানসিক ভারসাম্যহীন বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও। সুনামগঞ্জে ফেসবুকে ‘কল্লা কাটা’ শিরোনামে কবিতা লেখায় একজন ও ময়মনসিংহের তারাকান্দায় সন্দেহজনকভাবে একজনকে আটক করা হয়েছে। এদিকে গণপিটুনি বন্ধে পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর ছেলে ধরা গুজবের নেপথ্যে কুচক্রী মহলের বড় ষড়যন্ত্রের অংশ বলে জানিয়েছে ডিবি। রাজধানীর বাড্ডায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ছেলে ধরা সন্দেহে তসলিমা বেগম রানু হত্যায় তিন যুবকের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আরেক আসামি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ: দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘ছেলে ধরা’ গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে হত্যার মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে বলে মনে করে পুলিশ। এই পরিস্থিতিতে রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে গুজব রোধে সারা দেশের পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি-অপারেশনস সাঈদ তারিকুল হাসান সারা দেশের পুলিশের ইউনিটকে এই চিঠি পাঠিয়েছেন। ছেলে ধরার গুজব বন্ধ করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং ব্লগগুলোতে নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গুজবের নেপথ্যে কুচক্রী মহল-ডিবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলে ধরা ও মাথা কাটার গুজব ছড়ানো কুচক্রী মহলের বড় ষড়যন্ত্রের অংশ বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সোমবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।
৩ যুবক রিমান্ডে: বাড্ডায় প্রাইমারি স্কুলের সামনে ছেলে ধরা সন্দেহে তসলিমা বেগম রেনু হত্যায় তিন যুবকের ৪ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অপর দিকে আরেক আসামি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মণ্ডল শুনানি শেষে ওই তিন আসামির রিমান্ডের আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হলেন- মো. শাহীন, মো. বাচ্চু মিয়া ও মো. বাপ্পি। অপর দিকে, অপর আসামি জাফর হোসেন ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
কুষ্টিয়া: দৌলতপুরে জামাইবাড়ি বেড়াতে আসা হাসিনা খাতুন নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে ছেলে ধরা সন্দেহে সোমবার সকালে পিটিয়েছে এলাকাবাসী। ওই নারীর বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। একই দিন সদর উপজেলার আলামপুর কাথুলিয়ায় লালনভক্ত আনিছুর রহমানের পোশাক দেখে সন্দেহ হলে এলাকাবাসী গণপিটুনি দেয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক যুবককে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দুপুরে মিরপুর উপজেলার সাহেবনগর বহলবাড়িয়া থেকে এক পাগল ও ধুবাইল ইউনিয়ন পরিষদের সামনে থেকে এক পাগলিকে উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া সদর উপজেলার হাটশ-হরিপুর ইউনিয়নে কালাচাঁদ নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধাকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায়।
বগুড়া: গাবতলীর দুর্গাহাটা হাটে ছেলেধরা সন্দেহে জনগণ চার ব্যক্তিকে আটক করে মারপিট করেছেন। এ সময় তাদের পিকআপভ্যান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ তাদের থানায় আনার চেষ্টা করলে হাজার হাজার মানুষ পুলিশের ওপর চড়াও হন।
ওই চারজনকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবিতে পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে ৪-৫ জন পুলিশ আহত হয়েছেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং প্রায় চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাদের নিয়ে থানায় ফিরে আসে। এ সময় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ায় ১০-১২ উসকানিদাতাকে আটক করে থানায় আনা হয়েছে।
সাভার: সাভারে কোমলপানীয়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে এক তরুণীকে অজ্ঞান করায় ছেলেধরা সন্দেহে প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া এক দম্পতিকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। সোমবার দুপুরে পৌর এলাকার রাজাবাড়ী মহল্লায় এ ঘটনা ঘটে।
সৈয়দপুর (নীলফামারী): ছেলেধরা সন্দেহে সৈয়দপুর শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আবদুল মালেক, হেলাল হোসেন, মো. আবদুল গফুর ও মেরিয়ান খাতুনকে আটক করে গণধোলাই দেয়া হয়।
চারঘাট (রাজশাহী): চারঘাটে ছেলে ধরা সন্দেহে গণধোলাই দিয়ে ভুয়া এনজিওর পাঁচ কর্মীকে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ওই পাঁচ কর্মীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় তারা আদ-দ্বীন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের কর্মী বলে জানায় পুলিশকে। সোমবার দুপুরে উপজেলার রাওথা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
কুমিল্লা: বরুড়া উপজেলার ওড্ডা গ্রাম সোমবার ছেলেধরা সন্দেহে চার ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়েছে গ্রামবাসী। তারা হলেন - চান্দিনার ইলিয়টগঞ্জের সুলতান আহমেদের ছেলে মো. নজির, বাতাখাসি গ্রামের জমির উদ্দিন, দাউদকান্দি উপজেলার হরিপুর গ্রামের জয়নাল হোসেনের ছেলে আতিক মিয়া ও নূরে আলম।
চট্টগ্রাম: বাঁশখালীতে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে মারধর করা হয়েছে। ওই তিনজন সোমবার উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে গিয়ে মারধরের শিকার হন বলে পুলিশ জানিয়েছে। আহতরা হলেন- জনি, সোহেল ও হৃদয়।
মাদারীপুর: মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের বৈরাগীর বাজারে সোমবার ভারসাম্যহীন এক নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে।
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা): দুর্গাপুরে সোমবার ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক প্রতিবন্ধী রূপালী এক নারীকে স্থানীয়দের গণপিটুনি থেকে রক্ষা করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান ও দুর্গাপুর থানা পুলিশ।
লক্ষ্মীপুর: ঢাকার বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর দাফন রোববার রাত ৮টার দিকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে সম্পন্ন হয়েছে।
কমলগঞ্জ ও বড়লেখা (মৌলভীবাজার): কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া চা বাগানে ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার রাতে গণপিটুনিতে নিহত অজ্ঞাতনামা (৫০) ব্যক্তির পরিচয় এখনও উদ্ঘাটন হয়নি। এ ছাড়া কমলগঞ্জ থানার এএসআই আনিছুর রহমান বলেন, রোববার সন্ধ্যায় রহিমপুর ইউনিয়নের দেওড়াছড়া চা বাগান এলাকায় এক যুবককে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীরা পুলিশে সোপর্দ করেছে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। একই দিন মুন্সীবাজার ইউনিয়নের উবাহাটা গ্রামে ছেলে ধরা সন্দেহে শহীদুর রহমান নামের যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা): কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত দুই ব্যক্তি ছেলেধরা ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক তদন্তের পর এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ। সোমবার সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জ সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রামানন্দ সরকার এ তথ্য জানান।
নিয়ামতপুর (নওগাঁ): নিয়ামতপুরে ছেলে ধরা সন্দেহে আটক অজ্ঞাত ব্যক্তির সন্ধান এখনও জানতে পারেনি পুলিশ। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদেও মুখ খোলেননি তিনি। পরে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ: ‘কল্লা কাটা’ শিরোনামে কবিতা লিখে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ধর্মপাশা পশ্চিমবাজার সড়ক থেকে রোববার সন্ধ্যায় আলী আমজাদ আল আজাদ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামে সচেতনামুলক মাইকিং করেছে পুলিশ।
ভূঞাপুর ও মধুপুর (টাঙ্গাইল): ভূঞাপুরের ভ্যানচালক মিনুকে রোববার ছেলেধরা সন্দেহে কালিহাতী উপজেলার সয়া হাটে গণপিটুনিতে মারাত্মক আহত করার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। সোমবার দুপুরে ভূঞাপুর উপজেলার টেপিবাড়ি মোড়ে মানববন্ধন করেন তারা।
ঈশ্বরগঞ্জ ও ফুলপুর (ময়মনসিংহ): তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা গ্রামে রোববার রাতে গলাকাটা সন্দেহে পারভেজ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে জনতা পুলিশে দিয়েছেন। রোববার রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী): পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় সোমবার ছেলে ধরা আতঙ্কে চরনিশানবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অচেতন হয়ে পড়ে।
সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ): সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজ ও একই দিন মানসিক প্রতিবন্ধী গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মী ও ব্যবসীদের এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।