স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) রাজস্ব খাতে ২৫৭ প্রকৌশলীকে আদালতের নির্দেশে আত্তীকৃত করা হয়েছে। তাঁরা একসময় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতেন। এসব প্রকৌশলীর চাকরি নিয়মিত করার ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিধি মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এরপরও এক দফায় পদোন্নতি পেয়েছেন তাঁরা। এখন আরেক দফায় তাঁদের পদোন্নতি দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে এলজিইডির রাজস্ব খাতে কর্মরত অন্য প্রকৌশলীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
জানাগেছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত ব্যক্তিদের নানা সময়ে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আসা সহকারী প্রকৌশলী যেমন রয়েছেন, তেমনি সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে সরাসরি ও বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ পাওয়া প্রকৌশলীরাও আছেন। মূলত এসব পক্ষের মধ্যে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়েই জটিলতার সূত্রপাত।
উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত ব্যক্তিদের নিয়মিত করা ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে ২০০৫ সালে বিধিমালা করে সরকার। এলজিইডির নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রকৌশলী বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আসা সহকারী প্রকৌশলীদের সংস্থায় নিয়মিত করার বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। এটি এলজিইডির নিজেদের নথিতেই উল্লেখ করেছে। এরপরও যথাযথভাবে বিধি না মেনে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আসা প্রকৌশলীদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়েছে। এতে অন্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এবার জ্যেষ্ঠতার তালিকা না করে আবারও এসব প্রকৌশলীর পদোন্নতির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাকে অন্যায় বলে মনে করেন তাঁরা।
এসব সহকারী প্রকৌশলীর চাকরি নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পিএসসির সুপারিশ ছাড়া কোনোভাবেই চাকরি নিয়মিতকরণ করা যায় না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার তালিকাও থাকতে হবে। এই জটিলতা নিরসনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এলজিইডির একাধিক প্রকৌশলী অভিযোগ করেন, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আসা সহকারী প্রকৌশলীদের নিয়মিত করার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এরপরও তাঁদের মধ্যে ২০১৮ সালে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়া ৯৮ জনকে নির্বাহী প্রকৌশলীর পঞ্চম গ্রেডে চলতি দায়িত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিধি মেনে সঠিকভাবে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করা হলে এটি করা সম্ভব হতো না।
জানতে চাইলে এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিকুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে লোকবল আসায় কিছু সমস্যা তো রয়েছে। এই সহকারী প্রকৌশলীদের সবাই আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে যোগ দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, আদালতের নির্দেশে ২০১০ সালে ১৩১ জন, ২০১১ সালে ১০৯ এবং ২০১৩ সালে ১৭ জনকে সহকারী প্রকৌশলী (পুর) পদে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ করা হয়। আত্তীকরণ করা এসব প্রকৌশলীকে সংস্থায় নিয়মিতকরণ নিয়ে প্র্রশ্ন রয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিধি অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত পদধারীদের নিয়মিতকরণ ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ বিষয়ে একটি বিধিমালা রয়েছে। ২০০৫ সালের এই বিধি অনুযায়ী, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আওতাভুক্ত কোনো পদে আত্তীকৃত কর্মকর্তাদের নিয়মিত করতে হলে পিএসসির সুপারিশ লাগবে। কিন্তু এই ২৫৭ জন প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে পিএসসির সুপারিশ নেওয়া হয়নি।
তথ্য অধিকার আইনে করা একটি আবেদনের ভিত্তিতে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন গত ২৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, এসব সহকারী প্রকৌশলীকে রাজস্ব খাতে নিয়মিতকরণের বিষয়ে পিএসসির মতামত নেওয়া হয়নি।
নিয়মিতকরণ বিধিমালা অনুযায়ী, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আত্তীকৃত কর্মকর্তাদের রাজস্ব খাতে নিয়মিত করতে হলে চাকরির ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। কিন্তু ২৫৭ প্রকৌশলীর অনেকের ক্ষেত্রেই চাকরির ধারাবাহিকতা ছিল না। ২০১০ সালে এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে বলেন, মামলার রায় প্রাপ্ত ১১০ জনের মধ্যে অন্তত ১৪ জন তখন এলজিইডিতে কর্মরত ছিলেন না।
তথ্য অধিকার আইনে করা একটি আবেদনের ভিত্তিতে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন গত বছরের ২৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, এসব সহকারী প্রকৌশলীকে রাজস্ব খাতে নিয়মিতকরণের বিষয়ে পিএসসির মতামত নেওয়া হয়নি।
উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে সহকারী প্রকৌশলীদের পদায়নের যে প্রজ্ঞাপন সেখানেও নিয়মিতকরণের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ২০১০ ও ২০১১ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপনে চাকরির শর্তের ১ নম্বরে বলা হয়েছে, নিয়মিতকরণের আদেশ জারির তারিখ থেকে কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা গণনা করা হবে। কিন্তু এলজিইডি কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সময় এই প্রকৗশলীদের চাকরি নিয়মিতকরণের কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি।
রাজস্ব খাতে আসা অন্তত পাঁচজন সহকারী প্রকৌশলীর (পুরকৌশল) সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি নেই বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে চারজন বিএসসি অ্যাগ্রি (কৃষি) এবং একজন বিএসসি মেকানিক্যাল ডিগ্রিধারী।
এ অবস্থায় এলজিইডির রাজস্ব খাতের নিয়মিত প্রকৌশলীদের একটি অংশ আদালতের নির্দেশে আত্তীকৃত প্রকৌশলীদের পদোন্নতির বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
এলজিইডির একাধিক প্রকৌশলী অভিযোগ করেন, এলজিইডিতে সর্বশেষ ২০০৮ সালে জ্যেষ্ঠতা তালিকা অনুমোদন ও প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালা অনুযায়ী, অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা অনুসরণ ছাড়া পদোন্নতির বিধান নেই। কিন্তু অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা না থাকলেও প্রকল্প থেকে আসা সহকারী প্রকৌশলীদের ষষ্ঠ গ্রেডের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী (পুর) পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ২৬ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগে দেওয়া চিঠিতে তাঁদের মতামত তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আত্তীকৃত ২৫৭ জনকে নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে পিএসসির সুপারিশ গ্রহণসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে কি না, তা সুস্পষ্ট নয়। তাঁদের নিয়মিতকরণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করা সমীচীন হবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মতামত দেয়।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের প্রস্তাবগুলো নিরীক্ষা করে সুপারিশ করার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে এসব সহকারী প্রকৌশলীকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের কোনো প্রস্তাাব এলজিইডি থেকে অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগে পাঠানো হয়নি।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, এই সহকারী প্রকৌশলীদের চাকরি নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পিএসসির সুপারিশ ছাড়া কোনোভাবেই চাকরি নিয়মিতকরণ করা যায় না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার তালিকাও থাকতে হবে। এই জটিলতা নিরসনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।