প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২২, ২:৪৬
পদ্মা নদী পার হয়ে প্রায়ই শরিয়তপুরের জাজিরায় যেতে হত ঢাকার ব্যবসায়ী সুমন হাসানকে। এবার পদ্মা সেতু হয়ে যাত্রার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে বলেন, একটি ফেরির জন্য কত দিন যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি! কখনও যানজট তো কখনও কুয়াশা, কখনও ডুবোচর তো কখনও নাব্য সংকট। কখনও আবার স্রোত! নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল এই পথের ফেরি রুট। এখন পদ্মা সেতুর কারণে এ সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পেলাম।
পদ্মা সেতুর কারণে এমন অনেক বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ ঝরেছে সুমনের মত দক্ষিণবঙ্গগামী যাত্রীদের কণ্ঠে; তাদের চোখে ছিল স্বস্তির ছাপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে) দিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে টোল দিয়ে সেতু পার হয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে ছুটছেন যাত্রীরা। পদ্মা সেতু দিয়ে যাত্রা, তাদের ঈদ আনন্দ বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। তাই বিড়ম্বনাহীন এই যাত্রায় উচ্ছ্বাসেরও শেষ নেই।
ঈদের আগে শিমুলিয়া ঘাটে গিয়ে ফেরিতে ওঠা নামার সেই চিরচেনা প্রতিযোগিতা দেখা যায়নি। চোখে পড়েনি গাদাগাদি করে পদ্মা পারাপারের দৃশ্যও। উত্তাল পদ্মায় লঞ্চ-স্পিডবোটে নদী পার হওয়ায় নেই বাড়তি ঝুঁকিও। সব মিলিয়ে ঈদে প্রিয়জনের মুখ দেখতে রাস্তায় দুর্বিসহ ভোগান্তি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার সেই চেনা দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে পদ্মা সেতু।
যেখানে ঈদ যাত্রায় পদ্মা পার হতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখো মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি ঘাটে অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে এবার ৬ থেকে ৭ মিনিটেই পদ্মা সেতু দিয়ে গন্তব্যে যেতে পেরেছেন তারা।
মাওয়া টোল প্লাজায় পদ্মা সেতু হয়ে বাসে যাতায়াতকারী একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। ঢাকার বাসিন্দা হারুন বলেন, তার শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুর; সকালে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ফরিদপুর রেখে আবার ঢাকায় ফিরছেন। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ঈদের সময় ভোগান্তির কথা ভেবে বাসা থেকে বের হওয়ার কথা চিন্তা করতে পারতেন না। এখন পদ্মা সেতুর কারণে সে ভোগান্তি আর নেই।
বাগেরহাটগামী মান্নান শেখ বলেন, প্রায় ২৭ বছর ধরে আমি এই পথে যাতায়াত করছি। তবে এবারের ঈদ যাত্রার সাথে আগের কোনযাত্রাই মিলছে না। সারা রাস্তাই ছিল বিড়ম্বনাহীন। কিভাবে যে এখানে এসেছি; ভাবতেই অবাক লাগছে। একবারের জন্য কোথাও আটকে যাওয়ার দুশ্চিন্তা হয়নি। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!
নৌবাহনে পার হতে হচ্ছে না। ফলে এখন ঝড় হল কি বৃষ্টি, কুয়াশা আছে বা নেই, নদীর ঢেউ বাড়লো না কমললো কিংবা ডুবো চর জাগলো কিনা-তা নিয়ে কোন চিন্তা নেই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের। খরস্রোতা পদ্মা পার হওয়ার সময় বরং তার মুগ্ধতায় বিমোহিত হচ্ছেন তারা; এ যেন মহা প্রশান্তির এক অনুভূতি।
নদী পার হতে ফেরির অপেক্ষায় সড়কেই মৃত্যু হয়েছে রোগীর; সময় ফুরিয়েছে পরীক্ষার্থীর, প্রসূতির সন্তান প্রসব হয়েছে সড়কেই- এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী পদ্মার পাড়ের জেলাগুলোর বাসিন্দারা। পদ্মার দুই পাড়ের ফেরি ঘাট যেখানে শত বছরের ভোগান্তির সাক্ষী, সেখানে হবে বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র। মানুষ সেখানে ঘুরতে যাবে একটু প্রশান্তির আশায়।
সবই হবে যেন রূপকথা; ভবিষ্যত প্রজন্ম শুধু শুনেই যাবে পদ্মার গল্প। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত দক্ষিণাঞ্চলের জনগণ। তারা বলছেন, এই সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ২২ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়েছে তাদের। ২০০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকে যাতায়াতের এই সংকট সমাধানের স্বপ্ন বুনেছেন তারা। সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। এ উপলক্ষে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, রাজবাড়িসহ বরিশাল অঞ্চলে।