প্রকাশ: ৩ জুলাই ২০২২, ১:৪৮
ড. এম সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারীও তিনি। পদ্মা সেতুর ব্যবস্থাপনা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, টোল নির্ধারণসহ এ সেতুর ফলে রাজধানী ঢাকা শহরে যানজটের ওপর প্রভাব নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে। এটা একটা বড় অবকাঠামো। এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য কোন কোন দিকে নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
এম সামছুল হক: পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সুবিধা বা স্বস্তির জায়গা হচ্ছে এই সেতুর ৩৯ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড রয়েছে। এবং এই অ্যাপ্রোচ রোডে প্রবেশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত। এখানে চাইলেই কেউ ঢুকতে বা বের হয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের অন্য যেকোনো সেতুর তুলনায় এই সেতুর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনেক সহজ। পুরো এলাকা সিসিটিভি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং কেউ কোনো ধরনের অনিয়ম করলে তাকে সহজেই ধরা সম্ভব হবে। শুধু পদ্মা সেতু এলাকায় নয়, অন্য এলাকায় কেউ অপরাধ করলেও এখানে এসে তাকে ধরা পড়তে হবে। পদ্মা সেতু একটা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা একটা ট্র্যাপের মতো, এখানে যানবাহনের ওভারলোড ঠেকানো বা অপরাধী ধরা—সবই করা যাবে। কারণ, টোল প্লাজায় এসে সবাইকেই থামতে হবে। তখন পুলিশের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। আমি মনে করি যান চলাচলের সামগ্রিক শৃঙ্খলার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদ্মা সেতুর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করতে হবে। তা ছাড়া সেতুর দুই পাশে পুলিশের দুটি থানা রয়েছে। তাদের সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকার বিষয়টি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকতে হবে। এখানে শিথিলতার কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: যানবাহন চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর বিশৃঙ্খলার কারণে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
এম সামছুল হক: মহাসড়কগুলোর জন্য এখন বড় আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মোটরসাইকেল। আগে আমরা ভটভটি, নছিমনকে দোষ দিতাম। এখন তার জায়গা দখল করে নিয়েছে মোটরসাইকেল। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় শুরুতে আমরা দেখলাম যে মোটরসাইকেলের কারণে অধিকাংশ বুথ দখল হয়ে গেছে। সেখানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। অন্য বাহন পার হতে পারছে না, সেখানে দীর্ঘ জট তৈরি হচ্ছে। তাই যদি হয়, তবে পদ্মা সেতু যে উদ্দেশ্য নিয়ে বানানো হয়েছে, তা বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন: টোল দিতে হয় এমন সব সেতু দিয়েই তো মোটরসাইকেল পার হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সমস্যাটি এত প্রবল হলো কেন?
এম সামছুল হক: আমরা যদি বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর কথা বিবেচনা করি, তবে দেখবেন যে ওই সেতু ঢাকা থেকে বেশ দূরে। ফলে সেখানে চাপ অত বেশি নয়। কিন্তু পদ্মা সেতু ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় মানুষ মোটরসাইকেল নিয়ে সেতু পার হওয়ার চেষ্টা করছে। মোটরসাইকেল এভাবে পদ্মা সেতু পার হতে থাকলে সেতু পারাপারের পুরো ব্যবস্থাপনা ধসে পড়তে পারে।
প্রশ্ন: আমরা দেখলাম যে সরকার সাময়িকভাবে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেলের পারাপার বন্ধ করে দিয়েছে। এটা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। আপনার বক্তব্য মনে হচ্ছে সামনে মোটরসাইকেলের জন্য সেতু খুলে দেওয়া হলে একই সমস্যা দেখা দেবে। আপনি কি মনে করেন, এই সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল পুরো বন্ধ করে দেওয়া উচিত?
এম সামছুল হক: আমি মনে করি, বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ, মোটরসাইকেলের চলাচল পদ্মা সেতুর সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সেখানে যে এক্সপ্রেসওয়ে হয়েছে, তার উদ্দেশ্য দ্রুতগতিতে যান চলাচল নিশ্চিত করা। সেই রাস্তায় মোটরসাইকেলের চাপ ও চলাচল ভারী যানবাহনের চলাচলের গতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। নিরাপত্তার স্বার্থে ও দুর্ঘটনা এড়াতেও এটা জরুরি। ভারী যানবাহন যখন দ্রুতগতিতে চলে, তখন এর বাতাসও একটি মোটরসাইকেলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মোটরসাইকেলকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদের মহাসড়কগুলোতে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রশ্ন: উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টান্ত কী?
এম সামছুল হক: উন্নত দেশগুলোতে নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী সব করা হয়। তারা কোনটিকে উৎসাহিত করবে এবং কোনটিকে নিরুৎসাহিত করবে, সেই হিসাব-নিকাশ থাকে। সেখানে অনেক কিছু নিরুৎসাহিত করা হয় উচ্চ কর আরোপ করে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশনের খরচ গাড়ির চেয়ে বেশি। মোটরসাইকেল চালাতে হলে অনেক বাড়তি খরচ করতে হবে। আমাদের এখানেও এই বিষয় থাকা উচিত। আমরা কোনটিকে উৎসাহিত করব আর কোনটিকে নিরুৎসাহিত করব, সেই নীতি ঠিক করতে হবে। আমি তো মনে করি শুধু মোটরসাইকেল নয়, ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচলও পদ্মা সেতুতে নিরুৎসাহিত করা উচিত। উচ্চ টোল ধার্য করে সেটা সম্ভব। আমরা পদ্মা সেতু করেছি দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে, দেশ যাতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়, সেই বিবেচনা থেকে। পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট গাড়ির পারাপার সেই প্রবৃদ্ধি অর্জনে কোনো ভূমিকা পালন করবে না। বরং সেতুর সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পদ্মা সেতুতে চলাচলের ক্ষেত্রে বাস, ট্রাক ও লরিকে প্রাধান্য দিতে হবে। কার্গোকে হাইস্পিডে চলতে দিতে হবে। তাহলেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। মানুষ আসা–যাওয়া করবে বাসে, সে জন্য বাসের মতো গণপরিবহনের টোল কমানো যেতে পারে। ট্রাকের টোল কমালে পণ্যের দামের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এর সুফল সবাই পাবে।
প্রশ্ন: কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক মানুষ মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। কারণ, এখানে পর্যাপ্ত গণপরিবহন নেই।
এম সামছুল হক: ঢাকার ভেতরে চলাচলের ক্ষেত্রে এটা অনেকটা বাস্তব। উপায় নেই বলে ঢাকায় অনেক মানুষকে মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে হয়, ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু আপনি ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাবেন বা সেখান থেকে ঢাকা আসবেন, এর জন্য তো মোটরসাইকেল বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের দরকার নেই। দুটি কারণে বাসের মতো গণপরিবহনকে প্রাধান্য ও উৎসাহিত করতে হবে এবং মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারকে নিরুৎসাহিত করতে হবে এক. নিরাপত্তার কারণে, দুই. কার্যকর বিকল্প থাকার কারণে। জেলাগুলোর সঙ্গে যেহেতু বাস সার্ভিস রয়েছে, বাসে যাতায়াতে সমস্যা কোথায়? এখন পদ্মা সেতু হয়েছে, সরকার যদি বাসের মতো গণপরিবহনকে উৎসাহিত করতে চায়, তবে এ ক্ষেত্রে নীতিগত সমর্থন দেওয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারে। প্রয়োজনে পদ্মা সেতুতে যাত্রীবাহী বাসের টোল ব্যক্তিগত গাড়ি থেকেও কমিয়ে দিতে পারে। তাহলে পর্যাপ্ত ও ভালো মানের আরও বাস সার্ভিস চালু হবে। মূল বিষয়টা হচ্ছে সরকারের নীতিগত অবস্থান, সরকার কোনটিকে প্রাধান্য দেবে এবং কোনটিকে দেবে না, সেই নীতিটি ঠিক করতে হবে।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণের ২১টি জেলা রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সেতুর সুফল নিশ্চিত করতে এই জেলাগুলোকে ঘিরে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
এম সামছুল হক: ঢাকায় অনেক বিনিয়োগ হয়েছে, কিন্তু জেলা–উপজেলাগুলোতে হয়নি। কোনো উপজেলা শহরে গেলে আপনি কী দেখবেন? দেখবেন সরু ও অপরিকল্পিত রাস্তায় ইজিবাইক বা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে, জ্যামে সবকিছু থমকে আছে, কোনো বাস নেই, মানুষজন হাঁটছে। দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা ও এর উপজেলাগুলো যদি এভাবেই থেকে যায়, তবে পদ্মা সেতুর সুফল পুরো নিশ্চিত করা যাবে না। দক্ষিণের উপজেলাগুলোর যদি রূপান্তর ঘটানো যায়, তবেই সেখানকার মানুষ ঢাকার সঙ্গে যুক্ত থেকে এর সুফল ভোগ করতে পারবে। উপজেলা শহরগুলো গড়ে উঠেছে পুরোপুরি অপরিকল্পিতভাবে। এগুলোকে ঠিক করার কাজে হাত দিতে হবে। সেখানে স্মার্ট সিটি তৈরি করতে হবে। এ জন্য পলিসি তৈরি করতে হবে। কাজটি কঠিন, কারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে সঙ্গে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখন যা করা যেতে পারে তা হলো পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া। কোনো একটি উপজেলা নির্দিষ্ট করে এই কাজ শুরু করা যেতে পারে। সমন্বিত জমি উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে জনগণকে এর অংশীদার করতে হবে। এবং স্মার্ট সিটির পরিকল্পনা করতে হবে জোনভিত্তিক। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে সব ধরনের ব্যবস্থা সেখানে নিশ্চিত করতে হবে। এটা শুধু রাস্তা চওড়া করার বিষয় নয়। নগর–পরিকল্পনাবিদদের দিয়ে এ ধরনের সিটি তৈরির পরিকল্পনাটি করতে হবে। জমির সংকট যেহেতু আছে, তাই ঊর্ধ্বমুখী উন্নয়ন করতে হবে। উপজেলাগুলোতে এ ধরনের সিটি তৈরি করা গেলে মানুষ আর ঢাকায় থাকতে আগ্রহী হবে না। নিজের জেলা-উপজেলাতেই থাকবে আর প্রয়োজন পড়লেই কেবল ঢাকায় আসবে। শুরুতে জনগণকে এর সঙ্গে যুক্ত করাটা কঠিন হবে। নিজেদের জমি দিতে আস্থাহীনতায় ভুগবে। কিন্তু একটি-দুটি প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আস্থা তৈরি হবে, তখন আর সমস্যা হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শহর ও জনপদগুলোকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করছে। ভারতে ৩০টি শহরকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরের কাজ চলছে। চীনে হচ্ছে, আমাদেরও সেই পথ ধরতে হবে। আমাদের সুবিধা হচ্ছে এসব নিয়ে আমাদের খুব চিন্তা করার দরকার নেই, ট্রায়াল অ্যান্ড এররের বিষয় এখানে নেই। বিভিন্ন দেশের অনেক পরীক্ষিত মডেল আছে, যেগুলোকে আমরা আমাদের এখানে সহজেই কাজে লাগাতে পারি।
প্রশ্ন: পদ্মা সেতু দিয়ে খুব দ্রুত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে আসা–যাওয়া করা যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। ঢাকা শহরের বর্তমান যে দশা, তা কি এসব যানবাহনের চাপ ঢাকা নিতে পারবে?
এম সামছুল হক: দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে এখন যত দ্রুত যানবাহন ঢাকা পর্যন্ত চলে আসতে পারছে, সেই চাপ নিতে ঢাকা প্রস্তুত নয়। আমাদের পরিকল্পনা কমিশনে যদি নগর–পরিকল্পনাবিদ কেউ থাকতেন, তবে পদ্মা সেতু নিয়ে উল্লসিত হওয়ার আগে উদ্বেগ পেয়ে বসত। কারণ, তিনি বুঝতে পারতেন যে ঢাকা শহর এই চাপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। আরবান প্ল্যানিংয়ের বিষয়টি আমাদের এখানে চরমভাবে উপেক্ষিত। ঢাকার মতো শহরের জন্য আরবান প্ল্যানারের কোনো আনুষ্ঠানিক পদও নেই। এ রকম কেউ যদি থাকত, তবে তিনি বুঝতেন ঢাকা যেহেতু রাজধানী শহর, তাই এখানে সব জেলা থেকে যানবাহন এসে প্রবেশ করবে। কোনো দেশের রাজধানী মানে এটা অনেকটা স্টেডিয়ামের মতো। বৃত্তাকারের সব দিক দিয়ে এতে প্রবেশ করতে পারতে হবে। আমাদের দেশে আটটি ন্যাশনাল হাইওয়ের অভিমুখ ঢাকার দিকে। রাজধানীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এই স্টেডিয়াম কাঠামোর ধারণা সড়ক পরিকল্পনায় শত বছরের পরীক্ষিত একটি বিষয়। যেমন ঢাকার বাইরে থেকে যে সড়কগুলো রাজধানীতে ঢুকবে, সেগুলোর স্বতন্ত্র প্রবেশের বদলে একটি চক্রাকার রাস্তার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। এটা অনেকটা বেড়ি দিয়ে দেওয়ার মতো। ফলে ঢাকার বাইরে থেকে আসা কোনো একটি রাস্তায় চাপ দেখলে আরও সাতটি প্রবেশপথের যেকোনো একটি দিয়ে প্রবেশের সুযোগ নেবে। একটা রাজধানীর সড়ক নেটওয়ার্ক কী হবে, তা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত একটি বিষয়। শহরকে ঘিরে একটি রিং রোড থাকতেই হবে। এটা শুধু পদ্মা সেতুর বিষয় নয়। ঢাকায় প্রবেশ করা সব হাইওয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। সড়ক কাঠামোর এই যে ধারণা, এটা আমরা কোথা থেকে পেয়েছি, পেয়েছি প্রকৃতির কাছ থেকে। শিক্ষাটা আমরা নিয়েছি মাকড়সার জালের কাঠামো থেকে। যে কারণে পরিকল্পিত শহর ঘিরে অনেক রিং রোড থাকে। ইনার রিং রোড, মিডল রিং রোড, আউটার রিং রোড। এগুলো করা উচিত ছিল আরও ২০ বছর আগে। যখন জমি ছিল। তখন যদি আমরা সেগুলো না–ও করতাম, কিন্তু উচিত ছিল প্রভিশনটা রেখে দেওয়া। তাহলে বোঝা যেত আমাদের নগর-পরিকল্পনা বলে একটি বিষয় আছে। সেখানে এটা বিবেচনায় থাকত যে ভবিষ্যতে আমাদের একটি পদ্মা সেতু হবে, চট্টগ্রাম করিডর হবে, ময়মনসিংহ করিডর হবে, সিলেট করিডর হবে, আরিচা করিডর হবে। এগুলো সব তো ঢাকায় প্রবেশ করবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে যদি সব সড়ককে যুক্ত করে ঢাকাকে ঘিরে একটি রিং রোড থাকত, তবে বিভিন্ন পথে ঢাকায় প্রবেশের সুযোগ থাকত। এখন এত খরচ করে আমরা পদ্মা সেতু করলাম কিন্তু ঢাকাকে তো সেই যানবাহন প্রবেশের মতো করে প্রস্তুত করা হয়নি। এখন যখন এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে, তখন দেখা যাচ্ছে যথাযথ একটি রিং রোড বানানোর সুযোগ কমে গেছে, জমি পাওয়া যাচ্ছে না, যথাযথ নকশা করা যাচ্ছে না, আঁকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তার মানে আমাদের উন্নয়নটা অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি লাগিয়ে দেওয়ার মতো। ফেরিতে যে দুই ঘণ্টা নষ্ট হতো, পদ্মা সেতু তা বাঁচিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এরপর শহরে ঢুকতে গিয়ে যদি দুই ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়, তাহলে সেই একই ফল দাঁড়াল। আগে ফেরির বাধা, রাস্তার নানা সমস্যার কারণে যানবাহনগুলো রাস্তায় সময় নষ্ট করে আস্তে আস্তে শহরে প্রবেশ করত। এখন সেতু হয়েছে, রাস্তা ভালো হয়েছে, ফলে যানবাহন দ্রুত চলে আসবে। এগুলো এসে ঢাকার প্রবেশমুখে আটকে যাবে।
প্রশ্ন: স্বল্পমেয়াদি এমন কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া যায়, যাতে পরিস্থিতিকে কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়?
এম সামছুল হক: ঢাকায় প্রবেশের আগে একটি ডিজিটাল সাইনবোর্ড লাগানো যেতে পারে। উন্নত দেশে এগুলো থাকে, ভিজ্যুয়াল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা ভিএমএস। এই ডিজিটাল বোর্ডে চালকদের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাফিক তথ্য থাকবে। যেমন ঢাকামুখী বাহনটি পোস্তগোলা দিয়ে ঢুকলে কোন মাত্রার যানজটে পড়বে, অথবা বাবুবাজার, বছিলা বা মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের যানবাহনের চাপ কতটা। ঢাকা প্রবেশের আগেই চালক এটা পেলে কোন পথে ঢোকা তার জন্য সুবিধার হবে, সেটা জানতে পারবে। আমরা সাধারণত যানজটে গিয়ে পড়লে বুঝি যে যানজটে পড়েছি। তথ্য-উপাত্তভিত্তিক এ ধরনের ডিজিটাল বোর্ড করা গেলে যানজট পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যে যে যার যার গন্তব্য অনুযায়ী প্রবেশপথ বাছাই করতে পারবে। একজন চালক কিন্তু সংক্ষিপ্ত পথ নয়, বরং সংক্ষিপ্ত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়।
প্রশ্ন: সময় লাগলেও ঢাকাকে ঘিরে রিং রোড ছাড়া তো আমাদের সামনে কোনো পথ নেই।
এম সামছুল হক: ঢাকাকে ঘিরে রিং রোড আমাদের করতেই হবে। আগেই বলেছি, এটা শুধু পদ্মা সেতুর ব্যাপার নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা–সিলেট বা ঢাকা-ময়মনসিংহ করিডর—সবকিছুর জন্যই আমাদের এই রিং রোড লাগবে। এখানে অর্থের সংস্থানের জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ঢাকার জন্য এটা একটি জরুরি প্রকল্প, প্রয়োজনে নিজের অর্থে কাজটি করতে হবে। এই প্রকল্পটিকে প্রাধান্যের মধ্যে রাখতে হবে। দেরি করার কোনো সুযোগ নেই।
সূত্র: প্রথম আলো