বাংলাদেশে মহামারী করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তৃতীয় বারের মত চলছে জেলাভিত্তিক লকডাউন।এতে ঢাকার সাথে সকল গণপরিবহন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
কিন্তু সাভারের বাইপাইল এর চিত্রটা একটু ভিন্ন হাকডাকে সরগরম ঢাকার সাভারে বাইপাইলের বাস কাউন্টার গুলো। খুঁটিতে ঝোলানো মাইক, মাইকের সাহায্যে টাকা হচ্ছে যাত্রীদেরকে। আবার এক হাতে টাকা আর একহাতে হ্যান্ডমাইকে ডেকে আনা হচ্ছে যাত্রী। আবার খালি মুখেও যাত্রী ডাকাডাকি চলছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের উদ্দেশ্য যাত্রী ঠাসাঠাসি করে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছেড়ে যাচ্ছে মাইক্রোবাস গুলো। আটজনের সিটে নেয়া হচ্ছে বার জন কোন কোন গাড়িতে পনের থেকে আঠার জন। করোনা সংক্রমণের কোন ভয় নেই এখানে।
জিজ্ঞেস করা হলে যাত্রীরা একেক জনে একেক ধরনের অজুহাত দিচ্ছে । ৪০০ টাকার ভাড়া কয়েক গুন বাড়িয়ে নিলেও যাত্রীদের নেই জোরালো অভিযোগ। আর যারা যাত্রী ডেকে মাইক্রোবাসে তুলে দিচ্ছেন তারা মূলত কাজ করছেন মধ্যস্বত্ত্ব হিসেবে। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় কাউন্টারের স্টাফরাই মূলত এই কাজ করছেন। কমিশন হিসেবে যাত্রী প্রতি ২০০ টাকা মাইক্রোবাস চালকদের কাছ থেকে নিচ্ছেন তারা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাইপাইল আজিজ পাম্পের সামনে এমন চিত্র দেখে বোঝার উপায় নেই যে মারাত্মক করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। তাদের জাঁকজমকভাবে বাড়িতে যাওয়া যেন ঈদের ছুটি কেউ হার মানিয়ে ফেলছে।
সাত জেলায় চলছে লকডাউন। গ্রামেও বেড়েছে সংক্রমণ। এরই মধ্যে ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু ঢাকার প্রবেশমুখ বাইপাইল থেকে অবাধে যাত্রী বোঝাই করে সংক্রমিত এলাকা গুলোতে যাচ্ছে মাইক্রোবাস। মাঝে মধ্যে সুযোগ বুঝে যাত্রী নিয়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছেড়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বাসও। তবে এসব নজরদারিতে নেই প্রশাসনের কেউই। গতকাল বুধবার ও ৫০-৬০টি মাইক্রোবাস এখান থেকে ছেড়ে গেছে। নিয়ম না মেনে লোকাল বাস গুলোকেও যাত্রী বোঝাই করে চলাচল করতে দেখা গেছে।
দেখা গেছে, বাস না চললেও উত্তরাঞ্চল গামী বাইপাইল এর কাউন্টার গুলো খোলা।
ভিতরেও যাত্রীরা অপেক্ষায় আছেন বাস কিংবা মাইক্রোবাসের। প্রশ্ন করা হলে, অনেকেই করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। যেন কখনোই করনার নাম তারা শোনেনি। আবার অনেকেই জানাচ্ছেন নানান প্রয়োজনীয়তার কথা। মিথ্য অজুহাতেরও অন্ত নেই যেন। কেউ কেউ আবার কথা বলতেও নারাজ।
অন্যদিকে সাংবাদিক দেখে অনেক কাউন্টার গুলো সাটার বন্ধ করে সটকে পড়ছেন দ্রুত। মাইক্রোবাস ও বাসের স্টাফরা অনেকেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদককে। ক্যামেরা ধরলেই এদের অনেকেই আবার উপহাস করে ভিডিও করতে বলছেন গাদাগাদি করে যাত্রী তোলার দৃশ্য। হেয়ালিপনা করে ক্যামেরার সামনেই ডেকে যাত্রী মাইক্রো-বাসে তুলছেন তারা।
স্ত্রীকে রংপুর পাঠানোর জন্য অপেক্ষারত ব্যক্তি শাহিন আলম বলেন, ‘ওর ভাইবা ছিলো চট্টগ্রামে। কাইলকা এখান থেকে চট্টগ্রামে যাইতে পারে নাই। আবার রংপুরে ক্লিনিকে চাকরি করে। আইজকা না গেলে চাকরি থাকবে না। ভাড়াতো ১০০০ টাকা করে নিচ্ছে। যতটা সিট ততজন নিচ্ছে। আমাদের বলছে ১৩ জন যাবে।’
ভাড়া বেশি ও গাদাগাদি করে কেন যাচ্ছেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘সমস্যাতো হবে। উপায় নাইতো। নিরুপায় হয়েই যাওয়া লাগবে। গাড়িঘোরাতো নাই।’
হায়েসের যাত্রী শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেন, ‘১ হাজার টাকা ভাড়া নিচ্ছে। আমার বাড়িতে যেতেই হবে। বাড়িতে সমস্যা। কি করবো আমি?’
বগুড়ার যাত্রী আশারফ হোসেন বলেন, ‘গাদাগাদি হলে কিছু করার নাই ভাই। আমাদের বাড়িত যেতে হবে। ভাড়া ৬০০ টাকা নিছে।
হায়েস এর সামনে দাড়িয়ে থাকা এক বেক্তি বলেন, ‘মানুষ ভুগতে ভুগতে এমন এক জায়গায় চলে গেছে যাওয়ার আর জায়গা নাই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। গত রমজানের ঈদে মানুষ বাড়ি যাইতে পারে নাই। বিশেষ করে যারা মিডল পর্যায়ের মানুষ। তারা চিল্লাই কাঁদতে পারে না। তাদের লাইফটা শেষ। নেয়ার টু ডাই, মৃত্যুর কাছাকাছি দাড়ায় আছে মানুষ।’
‘আর কি চাচ্ছেন বলেন? করোনাটা কোথায়? হোয়াট ইজ কল করোনা? উই ডন্ট নো। সাধারণ মানুষ, রিকশাওয়ালার জানে না করোনাটা কাকে বলে? যারা এসি রুমে আছে তাদেরই করোনা হচ্ছে। তারা মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশের ৬৪টার বেশি ডিস্ট্রিক্ট আছে। একটা ডিস্ট্রিকে যদি ১৫টা করে থানা থাকে পারডেতো অ্যাভারজে এমনে নয়টা করে মারা যাবে। এখানে গাড়ি এক্সিডেন্ট আছে, হার্ট অ্যাটাক আছে, সুইসাইড আছে,ডাইবেটিকস আছে, আদার ডিজিস আছে।
এখানে করোনায়তো পাঁচটা বা দুইটা হতে পারে। ইটস নট এ্যা ম্যাটার। তাহলে অ্যাভারেজে মুত্যর হারটা কত হতে পারে? মিথ্যার একটা ঝুড়ি নিয়া বসে আছে মানে। প্রতিদিন করোনার রিপোর্ট দেয় ৫০, ৩৮, ৪০ জন । এটা কি? মানুষ বুঝে না? বাংলার প্রতিটা মানুষ বোঝে করোনায় কয়জন মানুষ মারা যাচ্ছে? মানুষ শুধু বলতে পারে না, প্রতিটা বাড়িতে মানুষ না খাইয়া মারা যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাইক্রোবাস চালকরা বলেন, গাড়ি না চালালে আমাদের খাবার দিবে কে? রাস্তায় পুলিশ আটকায়। কখনও ছাড়ে আবার কখনও ছাড়ে না। মামলা দিয়ে দেয়। লোকজনতো যায়। আমাদের কি করার আছে?
অন্যদিকে প্রতিবেদককে দেখে কাউন্টার বন্ধ করে দিয়ে চলে যান গ্রামীন, এমভি, শেরপুর ট্রাভেলসের কাউন্টারে থাকা একজন। কাউন্টারের ভেতরেও অপেক্ষায় বেশ ক’জন যাত্রী। তবে তারা কথা বলতে রাজি নন। এসময় ক্যাশকাউন্টার বসে থাকা ব্যক্তিও দ্রুত পালিয়ে যাওয়া সময় নীরব নামে আরেক ব্যক্তির সাথে কথা হয় ই নিউজ ৭১এর।
তিনি বলেন, ‘আমি আইসা এখানে এমনি বসছি। আমি গেস্ট। এমনি আসছি আমার আত্মীয় হয়। আমারে বসায় রাইখা গেলো। আমি কাউন্টারের না।’
বগুড়ার হানি পরিবহনে যাত্রী উঠানোর সময় এই প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করতেই তাকে ম্যানেজ করতে ছুটে আসেন কন্ডাক্টর রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছবি তুলা লাগবি না এদিকে আসেন। এডা ফিরতি গাড়ি। একটা যাত্রীও হয় নাইক্যা। তিন দিন হলো না খাইয়া আছি। কেউ কি ১০ ট্যাকা দিবি? হায়েসের মইদ্দে গাদাগাদি করি যাচ্ছি সেইটা ধরিচ্চেন না কেউ। আর গাড়িয়ালারা মনে করেন দুই সিটে একজন নিলে সমস্যা।’
পুলিশ ধরে কি না এমন প্রশ্নে বলেন, ‘রাস্তায় পুলিশতো ধরেই। বাস ১৫০০-২০০০ ট্যাকা জরিমানা কইরা ছাইড়া দেয়। হায়েস আর মাইক্রো ৫০০-১০০০ ট্যাকা দিলেই ছাড়ে। ওগোতে সমস্যাই নাই।’
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও ট্রাফিক বিভাগ) আব্দুল্লাহ হিল কাফী এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন,নবীনগর - চন্দ্রা মহাসড়কের নন্দন ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বারুইপাড়া আমাদের চেকপোস্ট আছে। কোন গাড়ি সাভার থেকে পাশের জেলা মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরে প্রবেশ করতে পারবে না। বিকল্প রুট ধামরাইয়ের কালামপুর হয়ে মির্জাপুরগামী অনেক বাস আটক করা হয়েছে। লোকাল বাসেও যারা অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।