প্রায় ১০ বছর আগে কামাল হোসেনের বাবা রফিকুল ইসলাম (৫৮) প্যারালাইসিস (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসার পরও কোনো উন্নতি হয়নি। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয়ের বদলে তার চিকিৎসার পেছনেই খরচ হয়েছে সহায়-সম্বল। তাই উপায়ান্তর না পেয়ে কামাল লেখাপড়া ছেড়ে যোগ দেন শ্রমিকের কাজে। কিন্তু ভাগ্য এবারও মুখ ফিরিয়ে নেয়। তিনিও আক্রান্ত হন প্যারালাইসিসে। এবার সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন।
অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তির পথ। একসময়ের ভবিষ্যৎ স্বপ্নে বিভোর থাকা শিক্ষার্থী আজ মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সংসারের খরচ জোগান। প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হতে হন পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য। প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে সরকারিভাবে ৭৫০ টাকা পান। তাতে অভাব দূর হয় না তাদের।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি ইউনিয়নের পশ্চিম বালিয়াহাট এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন কামাল হোসেন। পরিবারে তারা বাবা আর মা আছেন। তার মা মাঝেমধ্যে অন্যের কাজ করে কিছু আয় করেন। সরেজমিনে সেখানে গেলে কামাল শোনান তার কষ্টের জীবনের গল্প। কামাল বলেন, তার বাবার চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন। ঘরের একমাত্র ছাগলটি বিক্রি করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই সুস্থ হননি তার বাবা। একদিকে অসুস্থ বাবা, নিজের ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে সংসার। এত কিছুর পরও হাল ছাড়েননি তিনি। ২০১২ সালে বালাপাড়া স্কুল থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তারপর পরীক্ষায় পাসের সংবাদ খুশি বয়ে আনে সব পরিবারে। কিন্তু কামালের পরিবারে কোনো আনন্দ নেই।
নিয়ম অনুযায়ী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল কামালের। কিন্তু বই-খাতার বদলে তার হাতে ওঠে হাতুড়ি-বাটাল। শুরু করেন রাজমিস্ত্রির কাজ। হঠাৎ বছর চারেক আগে একদিন ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক হয় কামালের। তারপর আক্রান্ত হন পক্ষাঘাতগ্রনেস্ত। এতে তার দুই পা অচল হয়ে যায়। তবে তিনি জানান, ভিক্ষাবৃত্তির মতো পথে আর থাকতে মন চায় না তার। হতে চান স্বাবলম্বী। ছোট একটা মুদি দোকান করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। কিন্তু এত টাকা তো তার নেই মনে হলেই উড়ে যায় তার অধরা রঙিন স্বপ্ন।
কামাল হোসেন বলেন, আমি এসএসসি পাসের পর আশা ছিল কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু বাবার অসুস্থতা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। পরিবারের হাল ধরতে রাজমিস্ত্রির কাজ করে উপার্জন করতাম। ভালোই চলছিল। কিন্তু প্যারালাইসিস আমাকেও ঘরে বসিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমি কোনো উপায় না পেয়ে মানুষের কাছে ভিক্ষা চাই। অনেকেই দেয়, আবার অনেকে হাসে। আমার স্কুলের বন্ধুরা আমাকে দেখে নিন্দা করে। তাই আমি আর ভিক্ষা করতে চাই না। যদি একটা মুদি দোকান দিতে পারি। তাহলে আমি ঘুরে দাঁড়াতে পারব বলে আশা রাখি।
স্থানীয় জয়নাল, ফারুক, উসমানসহ বেশ কয়েকজন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাবা-ছেলে প্যারালাইসিসে ভুগছেন। সংসার চালানোর দুই উপার্জনক্ষম ব্যক্তিই অচল হয়ে পড়ে আছেন। কী দিয়ে চলবে তাদের সংসার? শুনেছি কামালের প্রতিবন্ধী ভাতা করা হয়েছে। সেখান থেকে মাসে সে ৭৫০ করে টাকা পায়। কিন্তু একটি পরিবার কি সেই টাকা দিয়ে চলতে পারে? সরকারিভাবে যদি একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে এ পরিবারটা খেয়েপরে চলেতে পারবে।
কামালের বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি প্যারালাইসিস রোগী। আমার ছেলেটারও একই অবস্থা। নিজেও কিছু করতে পারি না। ছেলেটাও পারে না। তাই ভিক্ষা করে। আমাদের জন্য সে নিজের পড়াশোনা পর্যন্ত ছেড়ে দিল। এখন সে একটা মুদি দোকান দিতে চায়। কিন্তু টাকা নাই। সমাজের কেউ যদি একটু সহযোগিতা করে, তাহলে সে কিছু করতে পারবে।
সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বনি আমিন বলেন, কামাল আমার কাছে এসেছিল। শুনেছি তার বাবাও প্যারালাইসিস৷
পরিবারের আয়-রোজগারের মতো আর কেউ নেই। তাই কামাল মানুষের কাছে ভিক্ষা করে পরিবার চালায়। আমি তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। এ ছাড়া যখনই কোনো বরাদ্দ আসে, তখনি তাকে দিই।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। একজন শিক্ষার্থী তার স্বপ্ন লেখাপড়া ছেড়ে অসুস্থ মা-বাবার জন্য পথে ভিক্ষা করছেন, বিষয়টি খুব কষ্টদায়ক। কামাল আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে একটা ব্যবস্থা করব।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।