সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির আদালত কক্ষে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ যে আদালত কক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করেন সে আদালত কক্ষে ৮টি সিসি ক্যামেরা চলমান রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমি এবিষয়ে কিছু জানি না। জানলে জানাবো।
এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে আপিল বিভাগের এই আদালতে ২১০ মিনিটের ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোল হয়। ওইদিন আদালতে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্যগত অবস্থার মেডিক্যাল প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। কিন্তু সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত প্রতিবেদন দিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সময় আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে মেডিক্যাল প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়ে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির জন্য ১২ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন।
সে সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড বৃহস্পতিবার না, শুনানিটা রোববার দিন, না হয় সোমবার দিন।’ তখন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলতে থাকেন বৃহস্পতিবার না, বৃহস্পতিবার না। রোববার শুনানির দিন ধার্য করা হোক। এক পর্যায়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তুমুল চিৎকার ও হট্টগোল করতে থাকেন। এর কাউন্টারে আদালতে উপস্থিত আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরাও চিৎকার করতে থাকেন। পরে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলতে থাকেন: ‘আমরা কোর্ট থেকে যাব না, আজ কোর্ট ছাড়ব না।’
এরকম চিৎকার ও হট্টগোলের প্রেক্ষাপটে ঠিক সকাল ১০টায় এজলাস থেকে উঠে চলে যান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। কিন্তু বিচারপতিরা চলে যাওয়ার পরও বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা আদালত কক্ষে বসে থাকেন। এরপর সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সহ আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা আপিল বিভাগ থেকে বেরিয়ে যান। তখন আদালত কক্ষেই বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে চলকেট বিতরণ চলে। সেই সাথে চলে খালেদার জামিনের পক্ষে বিভিন্ন শ্লোগান।
এরপর বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এজলাসে আসেন। এসময় আজকের কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলা শুনানির জন্য কল করা হয়। তখন আদালত কক্ষে অবস্থান করা বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা আবার হইচই শুরু করেন। তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘খালেদা জিয়ার জামিন চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আবার ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলেন: ‘মাই লর্ড আগের অর্ডারটা রিভিউ করুন প্লিজ। আগামী শুনানির দিন রোববার করে দিন।’ এর উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অর্ডার তো হয়ে গেছে, এখন আর নতুন করে কিছু করা সম্ভব নয়। আমরা এখন আর কিছু শুনব না।’ আদালতে থাকা বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা এসময় আবার চিৎকার শুরু করেন। তখন প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে উদ্দেশ করে বলেন; ‘বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা দরকার। আজ কোর্টে যে অবস্থা হলো সেটা নজিরবিহীন।’
সে সময় খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি শেষবারের মতো একটা কথা বলতে চাই।’ তখন আদালত তাকে বলেন, ‘আমরা এবিষয়ে আদেশ দিয়েছি। এখন আর কোনো কথা শুনব না।’ তখন খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন শুনানির তারিখ এগিয়ে আনার প্রার্থনা জানালে আদালত বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি, তাই জামিন শুনানির বিষয়টি বৃহস্পতিবার শুনব।’
এরপর দিনের কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলার শুনানির জন্য কল করা হলে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা আবার চিৎকার করে বলতে থাকেন: ‘অন্য কোনো মামলা শুনানি নয়। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। খালেদা জিয়ার জামিন চাই।’ একপর্যায়ে তারা সিট থেকে সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে তুমুল হইচই করতে থাকেন। তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জমিরুদ্দিন সরকার, মওদুদ আহমদ, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অন্য আইনজীবীরা আদালত থেকে বের হতে গেলে বিএনপিপন্থী জুনিয়র আইনজীবীরা তাদের যেতে না দিয়ে আগলে রাখে।
এরপর বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে আদালতের কার্যতালিকায় থাকা তার ৯ নাম্বার মামলা শুনানির জন্য ডায়াসে দাঁড়ান আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। এসময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা টেবিল চাপড়ান। এবং চিৎকার করে বলতে থাকেন খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি ছাড়া আর কোনো শুনানি আজ হবে না। এরকম হৈচৈয়ের মাঝেই সরকার সমর্থক ও বিএনপিপন্থী কিছু আইনজীবীর মধ্যে হালকা ধাক্কাধাক্কি হয়। ওদিকে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে টানা চলতে থাকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের স্লোগান। এক পর্যায়ে ১২ টা ১৫ মিনিটে তুমুল হৈচৈর প্রেক্ষাপটে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি তার শুনানি বন্ধ করে ডায়াসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর এজলাসে বসে থাকেন আপিল বেঞ্চের ছয় বিচারপতি।
সে সময় বিএনপিপন্থী এক তরুণ আইনজীবী দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, ‘আমার ফাঁসি দিন, তবু খালেদা জিয়ার জামিন দিন।’ আবার আদালতের সামনের সারিতে থাকা এক নারী আইনজীবী হাত জোড় করে বলতে থাকেন যে, ‘আপনারা ন্যায় বিচার করুন। খালেদা জিয়ার জামিন দিন।’
এরকম দৃশ্যপটের পর দুপুর ১ টা ১৫ মিনিটে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি যে মামলা শুনানির জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, সেটি শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে এজলাস ত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। এরপর আদালত কক্ষ থেকে বের হন বিএনপি ও আওয়ামীলীগ পন্থী আইনজীবী। প্রধান বিচারপতির আদালতে ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোলের ঘটনা তদন্ত এবং জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা চেয়ে গত ৮ ডিসেম্বর একটি লিগ্যাল নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী নিলু।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।