কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সড়কগুলো দীর্ঘদিন ধরে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত গাড়ির দখলে রয়েছে। অথচ এসব গাড়ি সড়কে চলাচলের কোনো অনুমোদন নেই। মজবুত ব্রেক না থাকলেও শ্যালো ইঞ্জিনের এসব অবৈধ গাড়ি চলে বেপরোয়া গতিতে। এমনিতেেই বিকট শব্দ করে চলা এই গাড়িতে আবার বাজানো হয় হাইড্রোলিক হর্ন। এসব অবৈধ গাড়ি দিন দিন বাড়াচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের অবৈধ গাড়ি চলাচল বন্ধের বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
উপজেলার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীত মৌসুমে চালু হয় ইটভাটা। আর বছরজুড়ে চলে এখানকার পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। এ ছাড়া বিভিন্ন মাঠঘাট থেকেও মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করা হয়। এই বালু ও মাটি পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত চালিত লাটাহাম্বা, বাটাহাম্বা, নছিমনসহ বিভিন্ন অদ্ভুত নামে সড়কে চলা অবৈধ এসব গাড়ি। এ ছাড়া ইট পরিবহনের ক্ষেত্রেও এসব গাড়ি ব্যবহার করা হয়। থানার মরদেহ বহনেও এগুলোই ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত স্টিয়ারিং গাড়ি। এগুলোর নেই হার্ড ব্রেক, নেই চালকের দক্ষতা। তবুও প্রশাসনের নাকের ডগায় এগুলো চলে, তাও আবার বেপরোয়া গতিতে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় থানায় মামলা হলেও বেশিরভাগ ঘটনায়ই মামলা পর্যন্ত গড়ায় না। পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা করে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে একাধিক পথচারী ও মোটরসাইকেল চালক জানান, পেছন থেকে হর্ন দিলেও এসব অবৈধ গাড়ি সাইড দেয় না। আবার সড়কের প্রচলিত নিয়মকানুন না মেনে তারা ওভারটেকও করেন, রাস্তা একটু ফাঁকা পেলেই পাল্লা দিয়ে চালান। এদের জন্য রাস্তায় চলতে প্রচণ্ড অসুবিধা হয়। থাকতে হয় দুর্ঘটনার অাতঙ্কে। এর আগে কুষ্টিয়ার সাবেক পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত যত্রতত্র গড়ে ওঠা শ্যালো ইঞ্জিনের এসব গাড়ি তৈরির কারখানা বন্ধ করে দেন। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেকে ফের কারাখানা মালিকরা এই অবৈধ গাড়ি তৈরিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
অন্যদিকে ব্যাটারি চালিত যানগুলোও রাস্তায় আরেক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। এদিকে ইটভাটা মালিকরা জানাচ্ছেন, পরিবহন খরচ কম হওয়ার কারণে শ্যালো ইঞ্জিনের স্টিয়ারিং গাড়িগুলোই বেশি ব্যবহার করা হয়। তবে বালু, মাটি ও ইট পরিবহনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রাকও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রশাসন স্টিয়ারিং গাড়ি বন্ধ করে দিলে তখন বিকল্প পরিবহন হিসেবে সবাই ট্রাকই ব্যবহার করতে বাধ্য হবেন। এ অবস্থায় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের ওপরেই নির্ভর করছে শ্যালো ইঞ্জিনের গাড়ি চলবে কিনা।
প্রায় দিনই উপজেলার কোথাও না কোথাও শ্যালো ইঞ্জিনের এসব গাড়ি ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। গত কয়েকদিনে এই শ্যালো ইঞ্জিনচালিত বাহনের ধাক্কায় অনেকে কমবেশি আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে গত ৮ জানুয়ারি পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য দৌলতপুর উপজেলা থেকে পাশের উপজেলা মিরপুরে যাওয়ার পথে অবৈধ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত স্টিয়ারিং গাড়ির ধ্বাক্কায় গুরুতর আহত হন মাছরাঙা টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি তাশরিক সঞ্চয়। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের এক অনুষ্ঠানের নিউজ কভার করতে মোটরসাইকেলে করে মিরপুর যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে এ উপজেলার শিতলাইপাড়া নামক স্থানে একটি ইটভাটার অবৈধ স্টিয়ারিং গাড়ি তার মোটরসাইকেলের সামনের অংশে ধাক্কা দিলে রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ে তিনি গুরুতর আহত হন।
এ ঘটনায় সাংবাদিক তাশরিক সঞ্চয় ঘাড়ের বাম দিকে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হন। এতে তার ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন ছুটে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন। এ ব্যাপারে তাশরিক সঞ্চয় দৌলতপুর থানায় মামলার জন্য ঘটনার দিনই এজাহার দেন। কিন্তু সেই এজাহারে খানিকটা পরিবর্তন করে তিনি বুধবার (১২ জানুয়ারি) পুনরায় এজাহারটি জমা দেন। পরে রাতেই পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করে। তবে পুলিশ এখন পর্যন্ত মামলার আসামি গ্রেপ্তার বা অবৈধ স্টিয়ারিং গাড়িটি জব্দ করতে পারেনি।
শিক্ষক আসাদুজ্জামান জানান, সড়কগুলো খুবই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এখানে রাস্তার পাশে নির্দেশনা চিহ্ন নেই। ফুটপাতও এই অবৈধ গাড়ির দখলে আছে। আর এসব স্টিয়ারিং গাড়ির ধাক্কায় বা চাপায় প্রতিবছর উদ্বেগজনকহারে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তাশরিক সঞ্চয় বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের চোখের সামনেই এ সমস্ত অবৈধ ও ভয়ঙ্কর গাড়ি দৌলতপুর উপজেলার রাস্তাঘাট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মালবাহী অন্যান্য ট্রাকও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বা বেপরোয়া গতিতে চলাফেরা করছে। বৃহত্তর স্বার্থে এগুলোর দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসএম জাবীদ হাসান জানান, সাংবাদিক তাশরিকের দুর্ঘটনার বিষয়টি শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। তার দেয়া সংশোধিত এজাহারের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার রাতেই মামলা নেয়া হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার এবং তাকে ধাক্কা দেয়া সেই স্টিয়ারিং গাড়িটি জব্দের ব্যাপারে পুলিশের চেষ্টা চলছে। পলাতক আসামিকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে সড়কে অবৈধভাবে চলাচল করা শ্যালো ইঞ্জিনের তৈরি গাড়িগুলো বন্ধের ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।