গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়ার দুধ খেয়েছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন তেলাপোকার দুধের কথা? অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, তেলাপোকাও দুধ দেয়। আর তাদের বাচ্চাদের দুধ খাইয়ে বড়ও করে তোলে।
তবে এই দুধ যদি একবার পান করেন, তবে আপনি পেতে পারেন গরুর দুধের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি পুষ্টি। এক্সসিএলআই (EXCLI) জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী, তেলাপোকার এই দুধের পুষ্টিগুণ সত্যিই অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মেট্রোর প্রতিবেদনেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক-এর নেপথ্যের আসল ঘটনাটি কী? ‘জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ক্রিস্টালোগ্রাফি’-তে প্রকাশিত হয় যে, স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো তেলাপোকাও দুধ দেয়। এই আবিষ্কার রীতিমতো চমকে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই বিশেষ প্রজাতির তেলাপোকা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিম পাড়ে না। স্তন্যপায়ীদের মতই তারা সরাসরি জন্ম দেয় বাচ্চাকে। আবার বাচ্চাদের দুধও পান করায়। সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধের চেয়ে চারগুণ বেশি পুষ্টি পাওয়া যায় এই তেলাপোকার দুধে। তবে এ ধরনের তেলাপোকা পাওয়া যায় একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে।
বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, মানব শরীরে অবস্থিত ইউটেরাসের মতোই তেলাপোকার শরীরে থাকে ‘ব্রুড স্যাক’, যেখানে ডিমগুলো জমা হয়। জমা হওয়ার ২০ থেকে ২৫ দিন পর ভ্রুণগুলোর মধ্যে দুধের ক্ষরণ হতে থাকে। আর জমা হওয়া ডিমগুলো তখনই সেই দুধ খেতে শুরু করে।
এই প্রজাতির তেলাপোকে ‘ডিপলোপ্টোরা পাঙ্কটেটা’ বলা হয়। তবে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সঙ্গে এদের পার্থক্য একটাই, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীরে দুধের জন্ম হয় সন্তান ভূমিষ্ঠের পর। আর এদের শরীরে দুধের জম্ম হয় ‘ব্রুড স্যাক’-এ ডিমগুলো জমা হওয়ার পর অর্থাৎ ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে।
পরবর্তী সময়ে গবেষকরা জানিয়েছেন, দুধের সঙ্গে ডিপলোপ্টোরা পাঙ্কটেটা বা পেসিফিক বিটল প্রজাতির তেলাপোকা মিশিয়ে খেলে মানুষের শরীরে দারুণ উপকার হতে পারে। এদের শরীরে থাকা প্রোটিন ক্রিস্টাল দুধের সঙ্গে মিশলে হয়ে উঠবে এক পুষ্টিসমৃদ্ধ সুপারফুড। আবার এই প্রকার তেলাপোকার দুধে রয়েছে ৯টি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। তেলাপোকা দুধকে ভবিষ্যতের সবচেয়ে উপযোগী সুপারফুড হিসেবে গণ্য করছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে এই ধরনের দুধ আমাদের জন্য কতটুকু স্বাস্থ্যকর-জানতে চাওয়া হয়েছিল পুষ্টিবিজ্ঞানী ইগজোনা মাকোল্লিকের কছে। তিনি বলেন, এই ধরনের দুধ নারী তেলাপোকা তাদের বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য ব্যবহার করেন। তবে প্যাসিফিক বেটল নামে এক ধরনের তেলাপোকা এ ধরনের দুধ উৎপাদন করতে পারে। পুষ্টিবিজ্ঞানী মাকোল্লি সংবাদমাধ্যম মেট্রোকে জানান, ২০১৬ সালে ভারতের গবেষকরা এ ধরনের দুধ থেকে পুষ্টিগুণ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
ওই গবেষকরা দেখান যে, এই তেলাপোকার দুধ হলো একটি প্রোটিন ক্রিস্টাল ধরনের দুধ, যেখানে ভালো পরিমাণে শক্তি রয়েছে। এ ছাড়া এই দুধে প্রচুর পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়।
তেলাপোকার দুধ কী?
তেলাপোকার দুধ হলো একটি প্রোটিন ক্রিস্টাল, যা ডিপলোপ্টোরা পাঙ্কটেটা নামক একটি তেলাপোকার প্রজাতি থেকে উৎপাদিত হয়। যাতে থাকে প্রচুর পরিমাণ অ্যামাইনো অ্যাসিড, প্রোটিন, ফ্যাট ও সুগার। এই কারণে গবেষকদের দাবি, অন্যান্য দুধের থেকে এই দুধের উপকারিতা বা খাদ্যগুণ অনেকাংশে বেশি।
পুষ্টিগত মান
এই প্রজাতীয় তেলাপোকার ‘ব্রুড স্যাক’ থেকে সংগ্রহ করা দুধের পুষ্টিতে থাকে ৪৫ শতাংশ প্রোটিন, ২৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ৫৫ শতাংশ অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং ১৬-২২ শতাংশ লিপিড। তা ছাড়াও এটিতে ওলিক অ্যাসিড, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড, গ্লিসারল এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ রয়েছে।
এটি কীভাবে সংগ্রহ করা হয়?
প্রথমে ব্রুড স্যাকে ডিমগুলো জমা হয়। এরপর ডিমগুলো ভ্রূণে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রুড স্যাকটি আস্তে আস্তে তাদের পুষ্টিকর খাবার প্রদানের জন্য এক প্রকার তরল জাতীয় পদার্থ উৎপাদন শুরু করে, যাকে দুধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর জমা হওয়া ভ্রুণ থলি থেকে দুধ খেতে শুরু করে, যা তাদের পেটে দুধের ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে।
ভ্রূণের শরীরে অতিরিক্ত দুধগুলো তাদের অন্ত্রে স্ফটিকের মতো এক প্রকার তরল পদার্থ গঠন করে। গর্ভবতী তেলাপোকার ব্রুড স্যাক থেকে ভ্রূণগুলোকে আলতোভাবে ছাড়িয়ে দিয়ে এই দুধ সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে এই তেলাপোকার দুধ উৎপাদনের ধারণাটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ ১ হাজার তেলাপোকা থেকে মাত্র ১০০ গ্রাম দুধ পাওয়া সম্ভব।
ভবিষ্যতে তেলাপোকার দুধ কীভাবে উপকারী হবে?
সমীক্ষা অনুসারে, তেলাপোকার স্ফটিক দুধের প্রোটিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মের সুপারফুড হতে পারে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই দুধ ক্যানসার, ডায়াবেটিস এবং ইস্কেমিক হৃদরোগের মতো নির্দিষ্ট কিছু রোগের ঝুঁকি রোধেও খুব পরিচিত।
এছাড়া যাদের দুধের প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের জন্য এটি একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। তবে ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর জন্য ব্যাপক অধ্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। অন্যদিকে এই প্রকার দুধের খারাপ দিকও রয়েছে।
যেমন, গরুর দুধের চেয়ে এর ক্যালোরির মাত্রা তিনগুণ বেশি। ফলে অত্যধিক পরিমাণ স্থূলত্ব বা ওজন সম্পর্কিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। গর্ভবতী নারী এবং শিশুদের এই দুধের ব্যবহার এড়ানো উচিত। কারণ এক্ষেত্রে এর কার্যকারিতার কোনো প্রমাণ নেই।
চূড়ান্ত দ্রষ্টব্য
তেলাপোকার দুধ বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ পানীয় নয়। যদিও বিজ্ঞানীদের মতে, এটি উচ্চ পুষ্টি যুক্ত পানীয় হিসেবে প্রমাণিত। হতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে এটি সবার জন্য উপলব্ধ হবে তবে, তা গবেষণার ওপর নির্ভর করছে।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।