গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে যে আটটি যুদ্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৮শে জুলাই ২০২২ ০৪:৫১ অপরাহ্ন
গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে যে আটটি যুদ্ধ

গেল দুই দশকে আটটি ভয়াবহ যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব। সন্ত্রাস দমন, সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে কিংবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সংঘাতে জড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।


তবে সেসব যুদ্ধ সামগ্রিকভাবে যত-না প্রভাব ফেলেছে, চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। কিন্তু কেন?


ইরাক যুদ্ধের সময়ও জ্বালানি সংকট এতটা প্রকট হয়নি

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ভয়াবহ নাইন-ইলেভেন বোমা হামলার পর ওয়ার অন টেরর নামে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দার সঙ্গে ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সংশ্লিষ্টতা ও ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির অভিযোগ এনে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্রিটেন ও পশ্চিমা বিশ্ব ইরাকে সামরিক অভিযান শুরু করে। যা পরে ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয়। ইরাক যুদ্ধের সময় তেলের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। সে সময় হঠাৎ করেই দেশে দেশে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা বেড়ে যায়। ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দিনে ৬০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন হলেও ২০০৩ সালে তা ২০ লাখ ব্যারেলে নেমে যায়। একপর্যায়ে ২০০৪-০৫ সালে দৈনিক তেল উৎপাদন ১০ লাখ ব্যারেলেও নেমে আসে। যার ফল ভোগ করে গোটা বিশ্ব। ২০০২ সালে জ্বালানি তেল ব্যারেলপ্রতি ছিল ২৬ ডলার। ২০০৫ সালে সেটি ৫৬ ডলারে গিয়ে ঠেকে। 


অন্যদিকে, আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেনে সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে।


ইয়েমেনে আধিপত্য বিস্তার সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব সামরিক জোটই মূলত নির্বাসনে যাওয়া প্রেসিডেন্ট আব্দরাব্বুহ মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় বসাতে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ইয়েমেনে সংঘাতের কারণেও বিশ্ববাজারে প্রভাব পড়ছে। কিছুদিন পরপরই সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন তেল স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে হুথি বিদ্রোহীরা। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে তেলের বাজারে। যেমন, ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আবকাইক তেল প্রক্রিয়াজাত কারখানায় হুথিদের হামলার পর অপরিশোধিত তেলের দাম ১৩ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম দাঁড়ায় ৬৮ ডলারে। তবে বর্তমানে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের চূড়ান্ত ফল ভোগ করছে বিশ্ব। যুদ্ধ শুরুর আগে ক্রুড অয়েলের দাম ৯৮ ডলারের নিচে থাকলেও বর্তমানে ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে।


বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্বালানি গ্যাস রফতানিকারক দেশ রাশিয়া। গোটা বিশ্বই জ্বালানির ওপর কোনো না কোনোভাবে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়াকে একঘরে করতে জ্বালানি তেল আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়াও ইউরোপীয় অনেক দেশে গ্যাস রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে৷ জ্বালানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিশ্বজুড়েই এর দাম বেড়েছে। ধনী দেশগুলো বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে জনগণের জন্য তা সহনীয় পর্যায়ে রাখলেও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার।

 

আফগানিস্তান যুদ্ধ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ নিহতের পর সে বছরের ৭ অক্টোবর আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট। একপর্যায়ে দেশটির ক্ষমতাসীন তালেবানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তারা। দীর্ঘ দুই দশক দেশটিতে ন্যাটোসহ ৪০টি দেশের সেনা নিয়োজিত ছিল। তবে সবশেষ গেল বছর মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার আগেই তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেয়। মোট রফতানি পণ্যের ৪০ শতাংশের বেশি ফল রফতানি করে থাকে আফগানিস্তান। তবে সংঘাতের কারণে ফলের পাশাপাশি শাকসবজি, তুলা, তেল, খনিজসম্পদ, কফি, চাপাতাসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানিতে বাধাগ্রস্ত হয় দেশটি। আর এসব পণ্যের বাজারমূল্যের ওপর প্রভাব পড়ে বিশ্বজুড়েই। আবার ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় সংকটের সূচনা। সমাধান আজও হয়নি।


২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ দমিয়ে গদি টিকিয়ে রাখতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান বাশার আল আসাদ। সেই থেকে যুদ্ধ চলছে। তবে যুদ্ধের কারণে অলিভ অয়েল, মরিচ, আলু, তুলা, কাচসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটি যে ভূমিকা রাখত, তা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়া যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা না দিলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন যেসব শস্য বড় আকারে রফতানি করে, তার মধ্যে রয়েছে সানফ্লাওয়ার অয়েল, ভুট্টা, গম ও বার্লি। অন্যদিকে একই শস্য বিশ্ববাজারে বড় আকারে সরবরাহ করে রাশিয়া।


যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলনিয়সের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে মোট গম উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়৷ আর ভুট্টার ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় এই দুই দেশে৷ যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে এই দুই দেশ থেকে গম ও ভুট্টাসহ অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের রফতানি৷ এই গ্রীষ্মে গম উৎপাদন করতে পারেনি ইউক্রেন৷ যে কারণে পুরো বিশ্বেই খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষ এখন দিশেহারা। বলা যায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়ে।


সাম্প্রতিক সময়ের ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়েই। যুদ্ধের জের ধরে দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা৷ মুদ্রাস্ফীতি চরমে, কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যয় সংকোচন নীতি নেয়া হচ্ছে৷ আমদানি পণ্যেও আরোপ হয়েছে নানা বিধিনিষেধ৷ দেশের মানুষের কথা ভেবে রফতানি বন্ধেরও পদক্ষেপ নিয়েছে কিছু দেশ৷ খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি সংকটের মুখে বিশ্বজুড়েই দাম বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের৷ বেড়েছে মার্কিন ডলারের দাম৷ ইউরোজোনে গত মাসে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে ৮.১শতাংশ৷ সারা বিশ্বেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো।


কোভিড মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই শুধু ইউরোপই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মাশুল গুনছে না, সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বকেই গভীর খাদে ফেলছে। যেখান থেকে উত্তরণের পথ কতটা সহজ কিংবা কঠিন হবে, তা সময়ই বলে দেবে।