ঝিনাইদহ পৌরসভার মোটা অংকের চেক জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়েছে। সাবেক মেয়রের চোখ ফাঁকি দিয়ে পৌরসভার একটি চক্র ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কাজের বিপরীতে ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ঝিনাইদহ পৌর কর্মচারী-কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
৭৪ লক্ষ ৫৮ হাজার টাকা অনিয়মের ঘটনা অডিট রিপোর্টে ধরা পড়লেও প্রথম অবস্থায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন কতৃক ১২ টি চেকের মাধ্যমে ২৮ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির তদন্ত করে জরুরী ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
যে তদন্ত কার্যক্রম এখন প্রায় শেষের দিকে বলে জানিয়েছেন ঝিনাইদহ স্থানিয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক মোঃ ইয়ারুল ইসলাম। সুত্র মতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় ও পৌরসভার আভ্যন্তরীন অডিট রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১ জুন থেকে ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের বিপরীতে এই টাকা উত্তোলন করা হয়।
ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নং একাউন্ট থেকে ৩৭টি ও ঝিনাইদহ জনতা ব্যাংকের ১৪২৫০৩ নং একাউন্ট থেকে একটি চেকে এই টাকা উত্তোলন করা হয়। তবে এই চেক জালিয়াতি নিয়ে পৌরসভায় চাকরীরত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। পৌরসভার সচিব আজমল হোসেন (বর্তমান যশোরের কর্মরত), প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন ও নির্বাহী পকৌশলী কামাল উদ্দীন পরস্পর মিলে হিসাব রক্ষককে চাপ দিয়ে এই চেক জালিয়াতি করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে পুর্নাঙ্গ তদন্তে মুল হোতাসহ দায়ীদের চিহ্নিত করা যাবে বলে সচেতন মহল মনে করেন।
এদিকে ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু চেক জালিয়াতির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ২০২১ সালের ২৭ জুন তাঁর দপ্তরের ২৯৬ নং স্মারকে প্রশাসনিক কমকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁনকে অন্যত্রে বদলি ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (পৌর-১ শাখা) বরাবর চিঠি দেন। চাঁন নিজের নামে কাজ দেখিয়ে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮১৯ টাকার স্থলে জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ২৮ লাখ টাকা লোপাট করেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় আসাদুজ্জামান চাঁন স্টোর কিপার হিসেবে চাকরীতে যোগ দিয়ে পরবর্তীতে প্রধান সহকারী ও পদোন্নতি পেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।
দীর্ঘ ২০ বছর তিনি একই কর্মস্থলে চাকরী করার কারণে প্রভাব বিস্তার করে নানা রকমের অনিয়ম ও পৌরসভার চেক নিজের নামে নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে চেকের পাতায় টাকার অংক বৃদ্ধি করে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাৎ করেন। চিঠিতে ঝিনাইদহ পৌরসভার স্বার্থ বিবেচনা করে আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন ও অন্যত্র বদলীর জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু। পৌর মেয়রের চিঠি পাওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন ২০২১ সালের ১২ আগষ্ট তাঁর দপ্তরের ৪৬.০০.০০০০.০৬৩.২৭.০০১.১৪.৬৭৮ নং স্মারকে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালককে অভিযোগসমুহ সরেজমিন তদন্ত করে জরুরী ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দশক্রমে অনুরোধ করেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রশাসনিক কমকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন ও সাবেক সচিব আজমল হোসেন মুলত এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা মেয়রের চোখ ফাঁকি দিয়ে চেক বইয়ের সামনের কিছু অংশ ফাঁকা রেখে পরবর্তীতে টাকার অংক বসিয়ে নিতেন। এ ভাবে বছরের পর বছর জালিয়াতি চক্রটি ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৬১৬ টাকা কাজের বিপরীতে ৮৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৯৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮২ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
পৌরসভার হিসাব বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সাইদুল করিম মিন্টু মেয়র হওয়ার ৫ বছর পর্যন্ত নাটের গুরু আসাদুজ্জামান চাঁন হাট বাজারের আয়কর ও ভ্যাটের টাকা জমা দেননি। এই টাকা তিনি পকেটস্থ করেছেন যার নথী তলব করলে অভিযোগের প্রমান পাওয়া যাবে। এদিকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১ জুন তারিখে পৌরসভার ক্যাশ বইতে জনৈক নওশের আলীর নামে ১০ হাজার টাকা লিপিবদ্ধ আছে। অথচ ১০ হাজার টাকার স্থলে সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নং একাউন্ট থেকে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে চার লাখ টাকা বেশি উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
নওশের ছাড়াও যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে তারা হলেন, প্রসাশনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চানের নামে ১২টি, নির্বাহী প্রকৌশলী কামাল উদ্দীনের নামে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ ৩০৬ নং ভাউচারে ৩ হাজার ২১২ টাকার স্থলে ২ লাখ ৩ হাজার ২১২ টাকা, ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টম্বর হিসাব রক্ষক মখলেছুর রহমানের নামে ৭৯ নং ভাউচারে ১৩ হাজার দুই’শ টাকার স্থলে ২ লাখ ১৩ হাজার ২০০ টাকা, ২০১১ সালের ৬ জুন দেলোয়ার হোসেনের নামে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২০১১ সালের ২৩ আগষ্ট এবং ২০ সেপ্টম্বর ১১৩ ও ১৫৫ নং ভাউচারে সাইদুর রহমানের নামে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৩ টাকার স্থলে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৩ টাকা, কনজারভেন্সি পরিদর্শক সামছুল আলমের নামে যথাক্রমে ১০, ৪৫, ১০০, ১৪৮ ও ৩৮২ নং ভাউচারে এক লাখ ৪৮ হাজার ২২ টাকার স্থালে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ২২ টাকা, ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি ২২১ নং ভাউচারে কমিশনার তোফাজ্জেল হোসেনের নামে ২১ হাজার টাকার স্থলে ২ লাখ ২১ হাজার,
২০১৩ সালের ১১ আগষ্ট ৩৭ নং ভাউচারে পানি বিভাগের বিল ক্লার্ক আনোয়ার হোসেনের নামে ৫ হাজার ৪০ টাকার স্থলে ২ লাখ ৫ হাজার ৪০ টাকা, একই বছরের ১১ আগষ্ট ৩৪ নং ভাউচারে কমিশনার মতলেব মিয়ার নামে ৫০ হাজার টাকার স্থলে দেড় লাখ টাকা, ওই বছরের ৪ ফেব্রয়ারি ২৪৩ নং ভাউচারে জনৈকা সাহিনা মৌসুমির নামে ১০ হাজারের স্থলে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা, ১১০ নং ভাউচারে কমিশনার সাইফুল ইসলাম মধুর নামে সোনালী ব্যাংকের ৩১৬ নং একাউন্ট থেকে যার চেক নং ৯৩৯৪৮৩৯ ৩০ হাজার টাকার স্থলে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা,
২০১৪ সালের পহেলা মে মাসে ৩০০ নং ভাউচারে মিঠু ইলেক্ট্রনিক্সের নামে ১৫ হাজার ৪১০ টাকার স্থলে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪১০ টাকা, ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রয়ারি ২১৯ নং ভাউচারে কমিশনার বশির উদ্দীনের নামে ৫০ হাজারের স্থলে আড়াই লাখ টাকা, ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর ঝিনাইদহ জনতা ব্যাংকের ১৪২৫০৩ নং চেকে রবিউল ইসলামের নামে ৯ হাজার ৬৫০ টাকার স্থলে ৪ লাখ ৯ হাজার ৬৫০ টাকা, ২০১২ সালের ১৮০ ও ২০১৪ সালের ২৮০ ভাউচারে স্যানেটারি ইন্সপেক্টর শংকর কুমার নন্দীর নামে ৭২ হাজার টাকার স্থলে ৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা এবং ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর ১৩৩ নং ভাউচারে ইঞ্জিনিয়ার মুন্সি আবু জাফরের নামে ২১ হাজারের বিপরীতে ১ লাখ ২১ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়।
এমন অভিযোগের একটির বিষয়ে সত্যতা জানতে ঝিনাইদহ শহরের মিঠু ইলেক্ট্রিকে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, তাদের দোকান থেকে ২০১৪ সালের পহেলা জানুয়ারি দুই হিসাবে ৩২’শ টাকা, একই বছরের ৭ জুলাই ২৫ হাজার ৫০০ টাকা, ২০ এপ্রিল ৯৩০০ টাকার হিসোব পরিশোধ করা হয়। কোনক্রমেই তাদের দুই লাখ টাকার বিল পৌরসভা দেয়নি। এই কেনাকাটার বিষয়টি দেখভাল করতেন পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন।
এব্যাপারে প্রশাসিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান চাঁন বলেন, চেক জালিয়াতি তো আমি করতে পারি না। এটি একাউন্ট কর্মকর্তা ভালো বলতে পারেন। একাউন্ট কর্মকর্তা মকলেছুর রহমান জানান, আমি এর সাথে কোন অবস্থায় জড়িত নই, আমি গত সাত বছর পৌর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের দেখা-শুনা করি। সাবেক সচিব আজমল হোসেন দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ পৌরসভার বর্তমান প্রশাসক ও ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক দপ্তরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক স্থানিয় মোঃ ইয়ারুল ইসলাম জানান, করোন প্রাদুর্ভাবের কারনে বিষয়টি তার কাছে দেরীতে উপস্থাপন হয়েছে। ফলে তদন্ত শুরু করতে দেরী হয়েছে। তিনি বলেন বর্তমানে ঝিনাইদহ পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান চাঁনের বিরুদ্ধে ১২ টি চেকের মাধ্যমে ২৮ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তদন্ত করে অভিযোগের প্রমান মিলছে। তিনি বলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের চিঠিতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণের সু-নির্দিষ্ট তারিখ নেই তবে দ্রুততম সময়ের মাধ্যমে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে তিনি জানান।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।