দেশে আমিষের ঘাটতি পূরণ করবে উটপাখির মাংস

নিজস্ব প্রতিবেদক
নেছার উদ্দিন খান, স্টাফ রিপোর্টার, সাভার:
প্রকাশিত: শুক্রবার ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৪৬ অপরাহ্ন
দেশে আমিষের ঘাটতি পূরণ করবে উটপাখির মাংস

আমিষের ঘাটতি পূরণ করবে উট পাখির মাংস। আর সেটা স্বপ্নে নয় বাস্তবে রূপান্তরিত করতে ২০১৯ সালের ১৮ জুন প্রধানমন্ত্রী অনুমদিত একটি প্রকল্পে ২২টি উট পাখি নিয়ে গবেষণা শুরু করে সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) এর বিজ্ঞানীরা। এটিই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উন্নত জাতের উট পাখি নিয়ে গবেষণা।


আফ্রিকান মরুভূমির এই পাখিগুলো আমাদের দেশের আবহাওয়ার জন্য কতটুকু উপযোগী তা নিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় গবেষণা চলছে। গবেষণার পর অধিক মাত্রায় মাংস উৎপাদনকারী এসব উটপাখি পৌঁছে দেওয়া হবে খামারি পর্যায়ে। দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে উটপাখি নতুন সংযোজন হবে বলে আশা করছেন এখানকার বিজ্ঞানীরা।


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন ভারত, নেপাল ও দ:ক্ষিন এশিয়ার মত কিছু কিছু দেশে এই প্রাণীটির উৎপাদন বেড়েছে।বাংলাদেশে এই পাখিগুলো পাওয়া না যাওয়ার কারণে দেশের বাইরে থেকে এর বাচ্চা সংগ্রহ বা আনতে হয় বলে আমাদের দেশে এর উৎপাদন গুরুত্ব পায়নি। এখন আমাদের দেশের আবহাওয়ায় উট পাখি পালন খুবই লাভজনক। উট পাখির মাংশ অনেকটা রেড মিট হলেও এতে আয়রনের পরিমান অনেক বেশি। কোলেস্টেরল ও ফ্যাট এর পরিমানও খুব কম থাকে। যার কারণে এটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি।


বৃহস্পতিবার  (১০সেপ্টেম্বর ) সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) এ গেলে দেখা মেলে এসব উট পাখির। একটি চতুর্ভোজ জালের দেয়াল দিয়ে দুই ভাগে রাখা হয় তাদের। প্রাপ্তবয়স্ক  উট পাখি তিনটি এক পাশে আলাদা করে রাখা হয়েছে ও অন্য পাশে চারটি বাচ্চা রাখা হয়েছে। এছাড়া দুইজন মানুষ রয়েছে তাদের দেখভাল বা পরিচর্যার জন্য। সেখানে প্রাকৃতিক ভাবে মাটিতে বেড়ে উঠা বিভিন্ন শাক ও ঘাষ ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে উট পাখিগুলো।


উট পাখিগুলোর পরিচর্যা ও দেখ ভালের দ্বায়িত্বে রয়েছেন তিন-চারজন। তারা বলেন, সকাল বেলা উঠে খামারে এসে আগে উট পাখিগুলো ছেড়ে দেই। তারপর দুইটি পাত্রে পানি দেই। পানি দেওয়ার কিছুখন পর আবার খাবার দেই। দিনে তাদের ৩-৪ বার খাবার দিতে হয়। তবে আমাদের এখানে প্রচুর খালি জায়গা থাকার কারণে বিভিন্ন ধরনের ঘাস লতা পাতা ও কলমি শাককেটে এনে তাদের দিয়ে থাকি। দুপুরে তাদের গোসল করানো হয়। তাদের উপর ঝরণার মত পানি দিলেই তারা নিজেরাই গোসল করে নেয়।


সবার আগে উট পাখি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ উম্মে সালমা এবং প্রফেসর ডঃ গাফফার মিয়া। তাদের তত্ববধানে শিক্ষার্থী পিএইচডি ফেলো খন্দকার তৌহিদুল ইসলাম বিএলআরই এ এসে উট পাখির উপর গবেষণা করছেন। খন্দকার তৌহিদুল ইসলাম ই নিউজ ৭১কে বলেন, আমরা ২০২০ সালের মাঝা মাঝি আফ্রিকা থেকে এই উটপাখি গুলো বাংলাদেশে গবেষণার জন্য এনেছি। আমাদের গবেষণার এখনো দুই বছর বাকি আছে। ইতিমধ্যে এক বছর চলে গেছে। আমরা এর ভেতর অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। সাধারণত তৃণভোজী অর্থাৎ ঘাস লতাপাতা ও দানাদার খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে উটপাখি। উট পাখি ৭ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এর ওজন ১৫০ থেকে ১৮০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে উট পাখির মাংসের বাজার মূল্য প্রতি কেজি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা।  গরু-ছাগলের বিকল্প হিসেবে তিনি উট পাখি পালন করা যায়। একটি গরু বছরে একটি মাত্র বাছুর দেয়। আর একটি উট পাখি বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৭০টি ডিম দিয়ে থাকে, যা থেকে কমপক্ষে ৫০টি বাচ্চা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর একটি উট পাখি তিন থেকে আড়াই বছর বয়সে প্রাপ্ত বয়সক হয়। এদের মাংসের গুনাগুন অনেক ভালো ও সুস্বাধু। বর্তমানে আমরা যেভাবে মুরগি পালন করি সেভাবে যদি উট পাখি পালন করি তাহলে দেখা যাবে উটপাখির প্রশারতা অনেক বেড়ে গেছে। এখন গবেষণা শেষে হলে আমরা উট পাখি কিভাবে বাংলাদেশে পালন করা যাবে তার সব কিছু বলতে পারবো।


বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এ উটপাখি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার। তিনি ই নিউজ ৭১কে বলেন, প্রথমিক অবস্থায় গবেষনার জন্য তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। অনেকেই শখে উটপাখি পালন করেছে। আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ভাবে উট পাখি পালন করা হয় না। তাই উট পাখি লালন পালনকে সহজলভ্য এবং এর মাংসকে জনপ্রিয় করার জন্য আমরা কাজ করছি। গুণাগুণ বিচারে উটপাখির মাংসের তুলনা হয় না। গত বছর দেশে আমিষের চাহিদার লক্ষমাত্রা পূরণ করতে সাউথ আফ্রিকা থেকে কিছু উটপাখি আনা হয়। এখানে পাখিগুলো লালন পালন ও গবেষণা চলছে। গবেষণার পাশাপাশি আমাদের দেশের পরিবেশে তাদের খাপ খাওয়াতে নতুন প্রজনন করা হচ্ছে। তিন বছরের গবেষণা শেষ হলে খামার পার্যায়ে পালনের জন্য পাখিগুলো খামারিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।


তিনি আরও বলেন, উট পাখির মাংশ ডাইয়েবেটিক রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। একটি বয়লার যে সময়ে গ্রথ হচ্ছে সেই একই সময়ে তিনগুন গ্রথ হচ্ছে এই উট পাখির । তার মানে যেহতু আমাদের মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে সেহতু এই উট পাখির প্রজাতির গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক বলে আমি মনে করি। আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি এই উট পাখি মাংসের জন্য একটি বড় সম্ভবনাময় পাখি। আমাদের এই বিপুল জনগোষ্টির ভেতরে নিরাপদ আমিষের যোগান দিতে গেলে মুরগি, হাঁস, টারকি, কয়েল, কবুতর ও তিতিরের পাশাপাশি উট পাখি পালন করলে মাংসের চাহিদা অনেক হাড়ে পুরোন হবে। মানুষের খাবারে বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি উটপাখির মাংস সুলভ মূল্যে তুলে ধরার জন্য আমাদের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। দ্রুতই বাংলাদেশে উটপাখির বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।