জাল-জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধনের জোগান দেয়া হলেও এখনও ঘাটতির পরিমাণ কমেনি; উল্টো বেড়েই চলেছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি খাতের ৬টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৫ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় প্রতিবেদনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ বেরিয়ে গেছে সেগুলোর প্রায়ই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণও বেড়ে যায়। এ কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। তারা আরও বলেছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির জোগান দেয়া হয় বাজেটে বরাদ্দ অর্থ থেকে। এই অর্থ আসে জনগণের করের টাকা থেকে। রাজনৈতিক নেতা, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যাংকাররা মিলে দুর্নীতি করে সরকারি ব্যাংকগুলোকে ফতুর করে দিচ্ছে। এ কারণে যে ঘাটতি হচ্ছে, ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখতে তা পূরণ করা হচ্ছে জনগণের টাকায়। তারা প্রশ্ন করেছেন, এভাবে জনগণের টাকায় আর কতদিন সরকারি ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেয়া হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মঙ্গলবার রাতে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ক্রমাগতভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি মূলধন ঘাটতি এসব ব্যাংককে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির দুর্নাম থেকে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হলে ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। তার আগে সরকারের সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার। তা না হলে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে মূলধন ঘাটতিতে আরও একটি ব্যাংক যোগ হয়েছে। ফলে ১০ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের জন্য বরাদ্দের বাজেট থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। গত আট বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাজেট থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার। এর পুরোটাই দেয়া হয়েছে জনগণের করের টাকায়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মঙ্গলবার রাতে বলেন, নিচের ছিদ্র বন্ধ না করে উপরে পানি ঢেলে কোনো লাভ হবে না। সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতি বন্ধ না করে জনগণের করের টাকা এভাবে মূলধনের জোগান দেয়া হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এর একটা শেষ হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, দুর্বল ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করার উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। এটি যেন সঠিকভাবে কার্যকর হয়। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে- দুর্বলের সঙ্গে কোনো দুর্বল ব্যাংক যেন একীভূত করা না হয়। তাতে আরও ব্যাংক দুর্বল হয়ে যাবে। একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক মার্জার করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ঘাটতি ৮ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। আগের বছর ঘাটতি ছিল ৭ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। কয়েকটি বড় জালিয়াতির ঘটনায় বিপর্যস্ত জনতা ব্যাংক ১৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
ঋণের নামে অর্থ লুটে নেয়া বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৭১২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
এ ছাড়া আরও দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ৬ হাজার ২০৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৫২ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৮৪ কোটি, এবি ব্যাংকের ১০০ কোটি ও বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঘাটতি হয়েছে ৪০ কোটি টাকা।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।