প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১১:৫৮
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে গঠিত গুম বিষয়ক কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন একটি জটিল, গভীর এবং গুরুতর রাষ্ট্রীয় সংকটের চিত্র তুলে ধরেছে, যা শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তির বিচ্যুতি নয় বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা এক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। কমিশনের কাছে দাখিলকৃত ১ হাজার ৮০০টিরও বেশি অভিযোগ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন নথি, এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের জবানিতে উঠে এসেছে যে, গুম একটি পরিকল্পিত এবং পদ্ধতিগত অপারেশনের অংশ ছিল, যেখানে আইন, বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল কার্যত অনুপস্থিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনায় ব্যক্তিগত উদ্যোগের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতা, অপারেশনাল অগ্রাধিকারের অজুহাত এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নীরবতা ছিল মূল চালিকাশক্তি। কমিশনের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গুমের ঘটনাগুলো একক কর্মকর্তার দায়িত্ব নয় বরং বিভিন্ন ইউনিটের যৌথ অপারেশনের ফল। অথচ এসব ঘটনা অনেক সময়ই নথিভুক্ত হয়নি, আর যেখানে কিছু তথ্য আছে, সেখানে 'গুম' শব্দটিই নেই। বরং সেসব নথিতে অভিযুক্তদের রাজনৈতিক যোগসূত্র, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে, কিন্তু গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার কোনো সরাসরি স্বীকারোক্তি নেই।
কমিশনের এক নজিরে দেখা যায়, একজন কর্মকর্তা যিনি সেনাবাহিনী থেকে র্যাবে প্রেষণে ছিলেন, তার বিরুদ্ধে গুমের 'প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ' থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন র্যাব মহাপরিচালক এবং পরবর্তীতে পুলিশের আইজিপি হওয়া বেনজীর আহমেদ তাকে 'অত্যন্ত দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা' হিসেবে প্রশংসা করেন। এ ধরনের মূল্যায়ন শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা বাহিনীর মূল্যবোধ ও বিচারবোধের সীমাবদ্ধতাকে সামনে আনে।
আরেক ঘটনায় দেখা যায়, একজন র্যাব কর্মকর্তা স্বীকার করেন তিনি দুজন মানুষকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারজন হত্যার সাক্ষী ছিলেন। অথচ এই স্বীকারোক্তির পরেও তাকে কোনো তদন্তের আওতায় আনা হয়নি, বরং তিনি যে টাকাগুলো পেয়েছিলেন তা মসজিদে দান করেছেন—এই তথ্যকে যেন নৈতিকতার ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সিনিয়র কর্মকর্তাদের মনোভাব ছিল এমন যে, নামাজ পড়া বা দান করার মাধ্যমে এসব অপরাধ মোচনযোগ্য, অথচ ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী মানুষের হক নষ্ট করা পাপ, যা আল্লাহও ক্ষমা করেন না।
এক জ্যেষ্ঠ জেনারেলের বক্তব্যে উঠে আসে আরও গভীর সংকট। তিনি বলেন, তিনি চেষ্টার মাধ্যমে সেনা সদস্যদের সতর্ক করেছেন যাতে তারা বেআইনিভাবে হত্যা না করেন। কিন্তু সেই সতর্কতা যে আদৌ কার্যকর হয়নি, তা বোঝা যায় সেই কর্মকর্তাদের কথায় যারা পরবর্তীতে সরাসরি গুম বা হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। এক সিনিয়র কর্মকর্তার জবানিতে বেরিয়ে আসে আরও এক বাস্তবতা—তিনি জানান, র্যাব থেকে ফিরে আসা কর্মকর্তাদের ডিব্রিফিংয়ে হত্যার হিসাব চাওয়া হতো, কিন্তু কখনো কোনো তদন্ত বা বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা হতো না।
প্রতিবেদনটি একটি দুঃখজনক চিত্র তুলে ধরে যেখানে তরুণ কর্মকর্তারা নিজেদের অসহায় মনে করতেন। তাদের অনেকেই বলেন, তারা এমন এক বাস্তবতার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, যেখানে না বলার সাহস ছিল না এবং একবার যুক্ত হয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে আসার কোনো পথ খোলা থাকত না। এই আতঙ্ক এবং অনুশোচনার মিশ্রণে একজন কর্মকর্তা বলেন, তিনি যতবার একজন বন্দিকে ধরে আনতেন, ততবার মনে হতো যদি পালিয়ে যেত, তবে হয়তো তাকেই হত্যা করা হতো।
এভাবেই বাহিনীর অভ্যন্তরে একটি নীরব ‘গৃহীত অপারেশনাল মানসিকতা’ গড়ে ওঠে, যেখানে অভিযুক্তরা অপরাধী নয় বরং ‘কর্তব্যরত’ হিসেবে বিবেচিত হতো। কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এই নীরবতা ছিল না শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে, বরং পুলিশ বিভাগেও এর অভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। উপ-পরিদর্শক পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেক সময় তাদের জোর করে এমন কাগজে সই করানো হতো, যা তাদের জড়িয়ে ফেলত গুরুতর অপরাধে, কিন্তু এতে বিরোধিতা করার সাহস তাদের ছিল না।
এই প্রতিবেদনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি গুমকে শুধুমাত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিত্রায়ন করেনি। বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর অভ্যন্তরে এক প্রাতিষ্ঠানিক সংকট, অন্ধ আনুগত্য ও নৈতিক বিভ্রান্তির চিত্র হিসেবেই তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদন ভবিষ্যতে কোনো বিচার বা সংস্কার প্রক্রিয়ার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।