প্রকাশ: ১ জানুয়ারি ২০২৪, ৩:৪১
বিদায়ী বছর ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বাজারে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নতুন বছর ২০২৪ সালে এসব সমস্যার থেকে মানুষ পরিত্রাণ পাবে কিনা তাই দেখার বিষয়। নতুন বছরে যেসব ইস্যু বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তা হলো-
নির্বাচন ও সরকারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যে পুরোপুরি ইতিবাচক নয়, তা তাদের বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছুদিন ধরেই চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধা দিতে চাওয়া ব্যক্তিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আনার ঘোষণাও দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর।
যুক্তরাষ্ট্রের পর নির্বাচন প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও। গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপিয়ান কমিশনের দুই সংসদ সদস্য কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়ে আহ্বান জানান যেন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ইউরোপও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়।
আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর এমন কঠোর অবস্থানের মধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেদের প্রার্থী বাছাই ছাড়াও কিছু জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রয়াস সত্ত্বেও নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ
গত বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার প্রায় সারা বছরই ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, তা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। জুলাই-অগাস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ শতাংশের ওপর।
অর্থবছর ২০২৩-এর প্রথমার্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন আর মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও সুদহার নির্দিষ্ট করে রাখার মতো সিদ্ধান্তগুলো মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
ডলারের দাম
বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছর ব্যাপক প্রভাবিত করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, ২০২২ সালের পহেলা জুন থেকে এখনও পর্যন্ত, অর্থাৎ গত দেড় বছরে টাকার তুলনায় ডলারের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। ডলারের এই বাড়তি দামের কারণে আমদানি এবং তার ধারাবাহিকতায় দেশের ভেতর উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করায় তা কেনার জন্য সাধারণ মানুষকেও গুণতে হয়েছে বেশি পরিমাণ টাকা।
ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন গত কয়েক বছর ধরে টাকার বিনিময়ে ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে আসছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা সবসময়ই এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এসেছেন।
রিজার্ভ সংকট
গত বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে গত জানুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, যা ডিসেম্বরে ২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর কথা।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফের নির্ধারিত হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, জুন মাসে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার যা নভেম্বরে ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত অর্থ, আইএমএফ’এর এসডিআর খাতে থাকা অর্থ, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ এবং আকুর বিল পরিশোধ বাবদ অর্থ হিসেবে নিলে রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমবে বলে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার, ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রেমিট্যান্স পাঠানোরও ভূমিকা আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ
গত বছরের গ্রীষ্মকালে বেশ কিছুদিন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক ক্ষেত্র, বিদ্যুৎ সংকট হয়রান করেছে সবাইকেই।
সে সময় সংকট তৈরি হয়েছিল মূলত রিজার্ভের ঘাটতি আর ডলারের সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির খরচ বহন করতে না পারায়। জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সময়মতো বকেয়া ফেরত দিতে না পারায় জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তারা।
যার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দেখা দেয় জ্বালানি ঘাটতি। ফলস্বরূপ বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। কিছু কেন্দ্র চলে সীমিত সক্ষমতায়।
তবে সামনের বছর ডলারের দামের পাশাপাশি তেল, গ্যাসের মতো জ্বালানিগুলোর দাম স্থিতিশীল থাকার পূর্বাভাস থাকায় তেমন সংকট তৈরি হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলা
বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সব অতীত রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৩ সালে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, গত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন, আর শুধু ২০২৩ সালেই সেই সংখ্যাটা ছিল ১ হাজার ৬৯৭ জন। আগের ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে যত মানুষ মারা গেছেন, গেল এক বছরেই মারা গেছেন তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষ।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির এই পর্যায়ে আসার পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, সিটি কর্পোরেশন-সহ প্রশাসনের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের মতো বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়।
তবে আশার বিষয় হল, সামনের বছরে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাত বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই পরিকল্পনায় চিকিৎসক, নার্সদের দক্ষতা বৃদ্ধি, কীটনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করা, ডেঙ্গু শনাক্তকরণে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত করা, কর্মসূচীর দুর্বলতা নির্ণয় করে নীতিগত পরিবর্তনের মতো বেশ কিছু বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন কৌশল প্রণয়ন করা হলেও এটি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য।
রাজনৈতিক অস্থিরতা
গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উত্তালই ছিল বলা যায়। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো প্রায় সারাবছরই সরকার বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষদিকে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে হওয়া সহিংসতার পর টানা ৬ সপ্তাহ হরতাল, অবরোধের মত কর্মসূচী পালন করেছে বিএনপি। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস, ট্রেনে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনায় অন্তত আটজন মারা গেছেন।
এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা আগামী বছরেও চলমান থাকার সম্ভাবনা থাকলেও একবার নির্বাচন হয়ে গেলে বিরোধী দলের আন্দোলন কার্যকারিতা হারাবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা