প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২২, ০:৪৩
দেশের জনপ্রিয় ইনিউজ৭১ অনলাইন পোর্টালে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত: সমুদ্রে চলছে জেলেদের মাছধরার মহোৎসব” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ হয়নি এখনও। মহিপুর-আলীপুর আড়দঘাটের দেড় শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার গভীর সমুদ্রে মাছ বোঝাই করে মালিকসহ আড়দদারদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করছে তীরে ফেরার জন্য। এমন খবর এখন ওই বন্দরের সকলের মুখে মুখে। ২/৩ টি মাছ ধরার ট্রলার প্রশাসনের ধাওয়া খেয়ে রাতের আধাঁরে নৌকায় এনে মাছ বিক্রি করে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করে সমুদ্রে রয়েছে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন কুয়াকাটা পৌর মৎস্য বাজারে একাধিক সুত্র।
মৎস্য বন্দর সুত্রে জানা গেছে, গভীর সমুদ্রে শত শত মাছ ধরা ট্রলার ইলিশ বোঝাই করে তীরে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। আড়তদার ও ট্রলার মালিকদের গ্রীন সিগনাল পেলেই এসব ট্রলার ইলিশ নিয়ে আলীপুর-মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সহ উপকুলীয় এলাকার বিভিন্ন মৎস্য আড়দে ঘাটে মাছ বিক্রি করতে। পাশাপাশি প্রশাসনকে ম্যানেজে মাঠে রয়েছে প্রভাবশালী আড়দারসহ জনপ্রতিনিধিরা। অনেক জেলেরা আবার সমুদ্র পথে ভোলা, বরগুনার পাথরঘাটা,বরিশালসহ বিভিন্ন মোকামে মাছ বিক্রির করছে এমন তথ্য জানিয়েছেন জেলেরা। সামুদ্রিক মাছ মহিপুর-আলীপুর অবতরন কেন্দ্রসহ সব আড়তগুলোতে স্বাভাবিক নিয়মেই বেচাকেনা চলছে। থেমে নেই বরফকলে বরফ উৎপাদন।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পাইকারদের সামুদ্রিক মাছ ক্রয় এবং মোকামে ট্রাক ও পরিবহনযোগে পাঠানোর দৈনন্দিন ব্যস্ততাও চোখে পরার মতো। নিয়মমাফিক রাজস্ব আদায়ের কাজ করছেন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের কমিশন আদায়কারী কর্মকর্তারা। এভাবেই জেলে-ঘাটশ্রমিক এবং ইলিশ ব্যবসায়ীদের কেউ বিন্দুমাত্র অবসরে নেই। ব্যাংকগুলোতে টাকার লেনদেনের কমতি ছিল না।
মহিপুর-আলীপুর ঘাটে মাছধরা ট্রলারগুলো নোঙর করে থাকবার কথা থাকলেও তা নেই। ব্যতিক্রম কেবল সরকারের ঘোষিত ৬৫ দিন সমুদ্রে মাছ শিকারের কাগুজে নিষেধাজ্ঞা! এর মধ্যেই সরকারের প্রণোদনার ৫৬ কেজি করে চাল কলাপাড়া উপজেলার ১৮ হাজার ৩’শ পাঁচ জেলের মাঝে বিতরণ সম্পন্ন, বাকী ৩০ কেজি করে চাল জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে দেবার কথা রয়েছে।
২২ মে থেকে শুরু হওয়া সামুদ্রিক মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৩ জুলাই। নিষেধাজ্ঞা ঘিরেই মাঠে লোকদেখানো তৎপরতা রয়েছে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, নিজামপুর স্টেশনের কোস্ট গার্ড, কুয়াকাটা নৌ পুলিশ, মহিপুর থানা পুলিশসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের। এমন চোর-পুলিশ খেলা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা মেনে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ রাখা জেলেদের ক্ষোভ রয়েছে।
আলীপুর মৎস্য বন্দরের জেলে মানিক, ইয়াছিন ও মিজানুর জানান, সমুদ্রে মাছ শিকার কাগজ-কলমে চলছে মৎস্য অধিদপ্তরের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এসময়ে সমুদ্রে মাছ শিকারে না যাবার জন্য তারা সরকারি সহয়তার চাল পেয়েছেন। কিন্তু প্রভাবশালী ফিশিং ট্রলার মালিকরা জেলেদের সমুদ্রে মাছ শিকারে যেতে বাধ্য করছেন। এর মধ্যে কুয়াকাটা নৌ-পুলিশ ও মহিপুর থানা পুলিশ এবং উপজেলার নিজামপুর স্টেশনের কোস্টগার্ড কয়েকদফা লোকদেখানো অভিযান পরিচালনা করেছেন বলেও অভিযোগ ওইসব জেলেদের।
জনবল ও নৌযানের স্বল্পতার অজুহাত ছাড়া কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, নিজামপুর কোস্ট গার্ড, কুয়াকাটা নৌ-পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই। সরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রসহ সামুদ্রিক মাছের আড়তঘাটে দেদারছে বেচাকেনা হচ্ছে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ। চলতি সপ্তাহে কুয়াকাটা পৌরসভায় মৎস্য আড়দে গড়ে প্রতিদিন ৫ টন ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ বিক্রি হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাধারণ জেলেরা জানিয়েছেন, মহিপুর-আলীপুরের শতাধিক ট্রলার গভীর সমুদ্রে এখন ইলিশ বোঝাই করে ভাসছে। এরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উপকূলে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
এদিকে আহরিত মাছ সংরক্ষণ, মজুদ ও বাজারজাত করণের সুবিধার্থে মহিপুর-আলীপুরের একাধিক বরফকল সচল রাখা হয়েছে। এমন তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে কলাপাড়া উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি সমবায় সমিতির সভাপতি নুরু মাঝি বলেন, কিছু প্রভাবশালী আড়তদাররা অসাধু জেলেদের বাধ্য করে সমুদ্রে পাঠিয়েছে। আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক শাকিল আহম্মেদ জানিয়েছেন, জেলেসহ দাদন ব্যবসায়ীরা নদীর মাছ বলেই বিএফডিসি পাইকারি বাজারে বিক্রি করছেন।
একই চিত্র মহিপুরের বিএফডিসি মার্কেটসহ কুয়াকাটা পৌরসভার মৎস্যবাজার, ধুলাসার, বাবলাতলা, বালিয়াতলী, চরচাপলী, আশাখালী, গঙ্গামতি, রাঙ্গাবালী, পাথরঘাটা, ভোলার চর স¤্রাটসহ উপকুলীয় এলাকার সামুদ্রিক মাছের আড়ৎঘাটে। নিষেধাজ্ঞা পালনকারী জেলেরা জানিয়েছেন, এতসবের পরও নিষেধাজ্ঞার সময়কালে সমুদ্রে মাছ শিকার কিংবা প্রকাশ্যে সামুদ্রিক মাছ বেচাকেনার কোথাও ছন্দপতন ঘটেনি।
প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, তথাকথিত সাংবাদিক, মৎস্য প্রশাসন, পুলিশ, কোস্ট গার্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজে অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীদের একটি চক্র মাঠে সক্রিয় রয়েছে। ফলে সরকার ঘোষিত মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে বলেও তারা মনে করছেন। অপরদিকে অবরোধকালীন সময়ে জেলেদের খাদ্য সহায়তায় সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রনোদণা কোন কাজে আসছে না।
আলীপুর বিএফডিসি মার্কেটের আড়ৎদার মনি ফিস’র মালিক আঃ জলিল ঘরামী বলেন, সাগরে শত শত মাছধরা ট্রলার এখন মাছ শিকারে রয়েছে, এর মধ্যে মহিপুর-আলীপুরের প্রভাবশালী ট্রলার মালিকদের রয়েছে অন্তত ত্রিশটি ট্রলার। নাম প্রকাশে অনুচছুক অপর এক আড়তদার বলেন, আলীপুর বন্দরের অনুমোদিত ট্রলিংও মাছ শিকারে গভীর সমুদ্রে রয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে প্রশাসনের সহযোগিতায়।
কোস্ট গার্ডের বরিশাল বিভাগের মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেফটেনেন্ট সাফিউল সাংবাদিকদের বলেন, গভীর সমুদ্রে টহলদানের বিষয়টি আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। তবে অবৈধভাবে সমুদ্রে মাছ শিকারীদের ঠেকাতে আমরা তৎপর রয়েছি। আড়ৎগুলোতে সামুদ্রিক মাছের বাজার বসার ব্যাপারে কোস্ট গার্ড কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাছ বিক্রি ঠেকানো দায়িত্ব তাদের নয়।