আর মাত্র কয়েকদিন পরেই বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এ উৎসব ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসছে বৈশাখী মেলা, আর এই মেলাগুলোর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে বাহারি কাগজের ফুল। শিশুদের খেলনা কিংবা প্রিয়জনকে উপহারের জন্য এসব ফুলের চাহিদা ব্যাপক।
এই চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নওগাঁর আত্রাই উপজেলার জামগ্রামের প্রায় ৪শ পরিবার। তারা রঙ-বেরঙের কাগজ, কাপড়, শোলা, বাঁশ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি করছেন স্টার, মানিক চাঁদ, চর্কি, গোলাপ, সূর্যমুখী, কিরণমালা, জবা, গাঁদা, বিস্কুটসহ নানা ধরনের বাহারি ফুল। দেখে মনে হবে, যেন একেকটা জীবন্ত ফুল।
প্রায় ৪০ বছর আগে জামগ্রামের ২-৩টি হিন্দু পরিবার এই ফুল তৈরির কাজ শুরু করলেও এখন তা পুরো গ্রামের প্রধান পেশায় পরিণত হয়েছে। এই শিল্পে নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও নিয়োজিত। পরিবারের সবাই মিলে তৈরি করছেন ফুল, আর পুরুষ সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বিক্রি করছেন সেগুলো।
জামগ্রামের ফুল কারিগর সুরুজ ইসলাম দুলু বলেন, “আমার দাদা এই কাজ শুরু করেছিলেন, তারপর বাবা, আর এখন আমি। ২০ বছর ধরে ফুল তৈরি করছি। আমার স্ত্রী আর দুই সন্তানও এ কাজে সহযোগিতা করে।”
একই গ্রামের মনিরুল ইসলাম কানন জানান, তার বাবাও এই পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। এখন তিনি, তার স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মা সবাই মিলে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে সংসার চালাচ্ছেন। “এই কাজ থেকেই আমাদের সংসার চলে। স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছে,” বলেন তিনি।
৫৫ বছর বয়সি ফুল ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বুলু বলেন, “জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি এই কাজের সঙ্গে জড়িত। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে জয়পুরহাট, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে মেলায় গিয়ে ফুল বিক্রি করি। তাবু খাটিয়ে নিজেরাই রান্না করি, আবার সব বিক্রি শেষ হলে বাড়ি ফিরে আসি।” তিনি জানান, এ মৌসুমে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।
ফুল তৈরির পেছনে নারীদের অবদানও কম নয়। আফরোজা বানু নামের এক গৃহিণী বলেন, “সকালে ঘরের কাজ শেষ করে আমি ফুল তৈরি করি। আমাদের মতো নারীদের শ্রমেই এই শিল্প এত বড় হয়েছে। যদি সরকার স্বল্প সুদে ঋণ দেয়, তাহলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারবো।”
এই ফুলের আয়ে শুধু সংসার চালাচ্ছেন না, অনেকেই চালাচ্ছেন সন্তানদের লেখাপড়াও। আত্রাই মোল্লা আজাদ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী পূজা বলেন, “বাবা ফুল বিক্রি করে আমাদের পড়াশোনার খরচ চালান। আমিও পাশে বসে ফুল বানিয়ে তাকে সাহায্য করি।”
পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে কাজ। গ্রামের যেদিকেই তাকানো যায়, দেখা যাবে কাগজ, কাপড়, বাঁশ, রঙে সজ্জিত ফুল তৈরির দৃশ্য। কেউ স্টার বানাচ্ছে, কেউ গোলাপে রঙ তুলছে, কেউবা বাঁশের কাঠি কেটে নিচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন বলেন, “জামগ্রামের এই ফুল তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। এতে শুধু আয় নয়, বাঙালির উৎসবগুলোতেও সৌন্দর্য যোগাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করবো এই শিল্পে নিয়োজিতদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে।”
এই ছোট্ট গ্রামের হাজারো হাতের পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে রঙিন এক বৈশাখ। গ্রামীণ কুটির শিল্পের সফল উদাহরণ হয়ে উঠেছে জামগ্রাম, যেখানে শিল্প ও সংস্কৃতি পাশাপাশি বেঁচে আছে পরম মমতায়।