গণহত্যায় স্মরণে নওগাঁয় দ্বিতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: শনিবার ২৫শে মার্চ ২০২৩ ০৭:৫০ অপরাহ্ন
গণহত্যায় স্মরণে নওগাঁয় দ্বিতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব

গণহত্যার কাহিনী তুলে ধরে নওগাঁয় দ্বিতীয় দেয়াল পত্রিকা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার দিনব্যাপী নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়োজনে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদ এর সহযোগিতায় স্কুল প্রাঙ্গনে এর আয়োজন করা হয়। জাতীয় সংগীত পরিবেশনা ও গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। স্কুল প্রাঙ্গনে দেয়াল পত্রিকা উৎসব হয়। দেয়াল পত্রিকায় শিক্ষার্থীদের লেখা পার-বোয়ায়িলা ও এর আশপাশে ঘটে যাওয়া গণহত্যায় নিহতের জীবনি হাতে লিখে এবং গ্রামের প্রকৃতি ও যুদ্ধের বিভিন্ন ছবি তুলে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানীরা নিরহ বাঙ্গালিদের ওপর নির্মম ভাবে হামলা চালিয়ে যে গণহত্যা করেছিল সেসব স্মৃতি তুলে ধরে আলোচনা করা হয়।


জানা যায়, দেয়াল পত্রিকা এক ধরনের হাতে লিখা পত্রিকা। যেখানে গল্প, কবিতা ও চিত্রাঙ্কনসহ অন্যান্য রচনা প্রকাশ করা হতো। এছাড়া গল্পকার ও সাহিত্যকরাও নিজেদের লেখা দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। এটি দেয়ালিকা নামেও পরিচিত। ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল এ দেয়াল পত্রিকা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলো তাদের কথা জানান দিতে হাতে লিখে দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশ করতো। যেখানে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা বের হতো। তবে পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা বেশি প্রকাশ করা হতো। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের সৃজনশীল প্রতিভা প্রকাশের জন্য নিজেদের চারপাশের পরিবেশ ও মনোজগতের বিষয়ে বর্হিপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে দেয়াল পত্রিকায় এখন বিলুপ্তির পথে। ফলে গুরত্ব কমেছে দেয়াল পত্রিকার। এখন ফেসবুকে স্থান করে নিয়েছে। সেখানেই তাদের মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে।


কিন্তু সময়ের বিবর্তনে পত্রিকাটি আজ বিদায়ের পথে। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের দেয়াল পত্রিকা বিষয়ে জানান দিতে কাজ করছে, স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠন ‘একুশে পরিষদ নওগাঁ’। নতুন করে তরুনদের জাগ্রত করতে এই প্রচেষ্টা।


দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী তানজিলা আক্তার ও নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ফাইজা ফারুক বলেন, দেশ স্বাধীনের আগে ২৫ মার্চ রাতে পার-বোয়ালিয়া সহ আশপাশের গ্রাম হত্যা চালিয়েছিল পাকসেনারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধ করেছিলেন, আহত হয়েছেন এবং প্রত্যক্ষদর্শী যারা ছিলেন তাদের সঙে কথা বলেছি। কিভাবে পাকসেনারা বাঙালীদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যা চালিয়েছিল। তাদের জীবনিগুলো হাতে লিখে আমরা প্রকাশ করেছি। যা দেয়াল পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। অনেকেই জানতাম না এ পত্রিকায় বিষয়ে গত দুবছর থেকে শিক্ষকদের সহযোগীতা এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন করা হচ্ছে। যারা ছোটরা আছে তারাও আগ্রহ দেখাচ্ছে গল্প সংগ্রহ ও নানান ছবি আঁকতে।


মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকসেনাদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া পার-বোয়ালিয়া গ্রামে যোদ্ধাহত জোসনা বেগম। তিনি বলেন, বয়স তখন প্রায় ১৫ বছর। সেসময় পাকসেনারা গ্রামের ঢুকে হামলা চালায়। আমরা নারীরা একটি ঘরে লুকিয়ে ছিলাম। পরে মুক্তিবাহীনিরা এসে আমাদের উদ্ধার করে এবং তারা চলে যায়। পরে আবারও পাকসেনারা এসে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমি দৌঁড় দিয়ে ধানের জমিতে পড়ে যায়। একপাকসেনা ধরে ফেলে বলে এতো মুক্তিযোদ্ধা না, এটা মহিলা। পরে রাইফেলের বাট দিয়ে বুকে আঘাত করে এবং পা দিয়ে লাথি দেয়। এতে বুকে জখম হয় এবং অনেক ফুলে ওঠে। পরে পাকসেনারা চলে গেলে পরিবারের লোকজন উদ্ধার করে চিকিৎসা করে সুস্থ করে। সেই আঘাতের চিহ্ন এখনো বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি। 


একুশে পরিষদ নওগাঁ’র সাবেক সাধারন সম্পাদক এমএম রাসেল বলেন, পাকসেনারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গণহত্যা চালিয়েছিল। নওগাঁ শহরের ২২ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। রাজাকারদের সহযোগীতায় পরদিন ২৩ এপ্রিল পার-বোয়ালিয়া ও এর আশপাশে গণহত্যা চালায় পাকসেনারা। তিন বছরের শিশু আব্দুল মান্নান, তার মা ও ভাইকে জবাই করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ৮৩ জন শহীদের পরিচয় পাওয়া যায়। সেইসব শহীদের জীবনি তুলে ধরে দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মনোভাব, আঁকাআকি ও লেখালেখির অভ্যাস বৃদ্ধি পাবে। এতে করে তাদের লেখার আগ্রহ ও জ্ঞানের পরিধি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।


এসময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ মজুমদার এর সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় যোদ্ধাহত জোসনা বেগম, একুশে পরিষদ এর সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুর বারী, সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন লিটন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএম রাসেল,উপদেষ্টা বিন আলী পিন্টু, সহসভাপতি প্রতাপ চন্দ্র সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিরুল ইসলাম রাসেল ও খন্দকার আব্দুর রউফ পাভেল, শিক্ষার্থী আবরার শাহারিয়ার সিয়াম ও ফাইজা ফারুক বক্তব্য রাখেন।