রসুল (সা.)-এর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা
রসুল (সা.)-এর সাহাবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় হলো, যারা ইমানের হালাতে স্বীয় জীবদ্দশায় ক্ষণিকের জন্য রসুল (সা.)-কে স্বচক্ষে দেখেছেন তাদের সাহাবি বলে। সাহাবিদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ মুমিনদের প্রতি নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট আছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার নিকট শপথ গ্রহণ করেছিল, আল্লাহ তাদের অন্তরের সব কিছুই অবগত আছেন। আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাদের আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন। (সূরা আল ফাতাহ : ১৮) সূরা তাওবার ২০ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই যারা ইমান এনেছেন, হিজরত করেছেন, আল্লাহর রাহে নিজেদের ধন-সম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছেন, তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে বহুগুণ বেশি।
আর এসব লোকই হচ্ছে সফলকাম। আলোচ্য আয়াত দুটিতে মহান রাব্বুল আলামিন অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে সাহাবায়ে কেরামদের কর্ম, দ্বীনের জন্য মুজাহাদা এবং তাদের সফল পরিণাম অর্থাৎ আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট, এ বিষয়টির কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সাহাবিরা এমন কী কাজ করেছেন? যার ফলে তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন? এ বিষয়টি জানা আমাদের সবার জন্য একান্ত কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
সাহাবিদের এই মর্যাদা অর্জন হয়েছে শুধু নবীপ্রেমের কারণে। নবীপ্রেমের যে নমুনা বিশ্ববাসীর কাছে রেখে গেছেন, তা কোনো লেখকের লেখনীতে, কোনো কবির কবিতায়, কোনো দার্শনিকের দর্শনে, কোনো বক্তার বক্তৃতায়, কোনো শিল্পীর তুলিতে, কোনো বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানে, এমনকি কোনো গল্পকারের গল্পে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব নয়। সাহাবিদের লাখ লাখ চক্ষু সার্বক্ষণিক রসুল (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকত। কোনো করণীয় ও বর্জনীয় আমল প্রিয় রসুল (সা.) থেকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমলে রূপান্তরিত করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। কার আগে কে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। শত্রু কর্তৃক প্রিয় রসুল আক্রান্ত হোন কিনা সেদিকে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখতেন। নবীপ্রেমে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন। যেমন সন্তান প্রিয় মায়ের স্নেহ-মমতা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, ভাই-বোনের হৃদয় নিংড়ানো দরদ, এমনকি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে স্বীয় বাপ-দাদার বসতভিটা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ এবং নিজেদের ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি পেছনে রেখে প্রিয় নবীর সংস্পর্শে লাভের আকাঙ্ক্ষায় অজানা-অচেনা পথ ধরে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। পেছনে রেখে আসা সহায়-সম্পত্তির জন্য জীবনে কখনো আক্ষেপ পর্যন্ত করেননি। হ্যাঁ, আক্ষেপ করেছেন শুধু প্রিয় রসুলের সংস্পর্শে কিংবা তার আদেশ-নিষেধে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে। প্রিয় নবীর শুধু অঙ্গুলির ইশারায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও তারা কোনোরূপ দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করে দেখুন তো? নবীজী এমন কি আকর্ষণ দেখিয়েছেন যে, তার জন্য নিজের প্রিয় জীবনসহ সর্বস্ব ওয়াক্ফ করে দিতে হবে। হ্যাঁ, তিনি শুধু সাহাবাদের নিজেদের খালেক (স্রষ্টা)-এর আকর্ষণ দেখিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ইবলিসের আকর্ষণ বর্জন করতে তাকিদ করেছেন। ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার রাস্তা দেখিয়েছেন। অভিজ্ঞ সাহাবিরা বিচার-বিশ্লেষণ করে চিরশান্তির রাস্তা অবলম্বন করেছেন। আর এই রাস্তা পেতে হলে নবীজীর ভালোবাসা লাগবে। অন্যথায় তা সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআনে সূরা আলে-ইমরানের ৩১ ও ৩২ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন।
আর আল্লাহ ক্ষমাকারী, পরম দয়ালু। বলুন, আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুত, যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না। ওই আয়াত দুটিতে আল্লাহ প্রেমের মাপকাঠি বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর প্রেম পেতে হলে নবীর প্রেম লাগবে। নবীর তরিকার অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে। এই ছাড়া আল্লাহর প্রেম পাওয়া যাবে না। সাহাবিদের নবীপ্রেমের বিস্ময়কর ঘটনাবলি অসংখ্য অগণিত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। বুখারি শরিফে এক রেওয়াতে এসেছে, সাহাবিদের নবীপ্রেমের বিস্ময়কর ঘটনা, কুরাইশদের দূত ওরাওয়াহ ইবনে মাসউদ ছাকাফি মুসলমান হওয়ার পূর্বে, হুদায়বিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধিচুক্তিকালে, গোয়েন্দা হিসেবে সাহাবিদের অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে মদিনায় আগমন করেছিলেন। মদিনায় কয়েক দিন সাহাবিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পর মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের কাছে সাহাবিদের নবীপ্রেমের কাহিনী এভাবে বর্ণনা দেন।
হে আমার জাতি! আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের পক্ষ থেকে দূত হিসেবে রোমের সম্রাট, ইরানের শাহেনশাহ এবং আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে গিয়েছি। আল্লাহর কসম, কোনো রাজা-বাদশাহর প্রতি তাদের প্রজা ও সহচরদের এমন ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিনি যেরূপ দেখেছি মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের ভালোবাসা। আল্লাহর কসম করে বলছি, মুহাম্মদ (স.)-এর মুখের থুথুকে তারা জমিনে পড়তে দেয় না। অতি ভক্তির কারণে সেই থুথুকে সংরক্ষণ করে রেখে নিজেদের সুঘ্রাণ হিসেবে তা শরীরে ব্যবহার করেন। (উল্লেখ্য, যে রসুল (সা.)-এর থুথু মেশকআম্বর থেকেও বেশি সুঘ্রাণযুক্ত ছিল)। তিনি যখন কোনো কাজের হুকুম দেন তখন সাহাবিদের মাঝে তা পালনের প্রতিযোগিতা লেগে যায়। তার অজুর অতিরিক্ত পানি তারা বরকতের জন্য রেখে দেয়। প্রিয় রসুলের সামনে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা তারা একেবারেই পছন্দ করেন না। অতি ভক্তির কারণে রসুল (সা.)-এর দিকে চক্ষু তুলে তাকানোরও সাহস পান না। সুবহানাল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবার হৃদয়ে নবীপ্রেম জাগ্রত করে সুন্নতি জীবন দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক : হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, প্রিন্সিপাল, শাহজালাল রহ, ৩৬০ আউলিয়া লতিফিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা উপশহর সিলেট।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।