প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে আর জোটে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে এই সিদ্ধান্তের কথা দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে না। বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তারা ২০-দলীয় জোটের কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় থাকবে। জামায়াতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এই সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার বৈঠকে বিএনপির সঙ্গে আর না থাকার এ সিদ্ধান্ত হয়। দলের নির্বাহী পরিষদকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, দেশে এখন কোনো আন্দোলন নেই, নির্বাচন নেই। তা ছাড়া জোটের প্রধান দল বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে রাজনীতির মাঠে ২০-দলীয় জোটের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে জামায়াতও শরিক দল হিসেবে বিএনপির কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে।
সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঐক্যফ্রন্টকে প্রাধান্য দিয়েছে বিএনপি। ওই নির্বাচনে জোটের আসন ভাগাভাগিতে জামায়াত চাহিদা অনুযায়ী আসন পায়নি। যে কয়টি আসন পেয়েছে, সেগুলোতে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও গড়িমসি ও দীর্ঘসূত্রতা করে বিএনপি। এই অবস্থায় জামায়াতের নেতাদের উপলব্ধি হচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে থাকার কারণে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতাসীনদের রোষের শিকার হচ্ছেন। বিএনপির সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি গতকাল সোমবার বলেন, ‘সংগঠনে কত সিদ্ধান্তই হয়। জানানোর মতো কিছু হলে আমরা তা গণমাধ্যমকে জানাই। এ রকম কিছু হলে সময়মতো আমরা বলব।’
অবশ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা এবং দলের শুভাকাঙ্ক্ষী ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ অনেক দিন ধরে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। জামায়াতের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকের বিরূপ ধারণা আছে। কিন্তু ভোটের মাঠের নানা হিসাব-নিকাশে জামায়াতকে ছাড়েনি বিএনপি। এখন জামায়াতই বিএনপিকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন জামায়াত যদি জোট ছেড়ে যায়, বিএনপি তাদের ফেরানোর চেষ্টা করবে না। এ কারণে ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি জামায়াতের প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দের জন্য চিঠি দিতে বিলম্ব করা হয়। জামায়াত তাদের জন্য বরাদ্দ আসনে একাধিক চিঠি চাইলেও তা দেয়নি বিএনপি। এ নিয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের রাতে বিএনপির কার্যালয়ে গিয়ে চিঠি ফেরত দেন। পরে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার হস্তক্ষেপে গভীর রাতে বিষয়টি মিটমাট হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘জামায়াত বেরিয়ে গেলে খুশি হব আমরা। বিএনপিরও উচিত হবে না আর জামায়াতকে জোটে যুক্ত রাখা। কারণ, এই মুহূর্তে জামায়াতকে সঙ্গে রাখা লাভজনক ব্যাপার নয়, বরং দায় হয়ে গেছে।’ তবে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার কারণে সরকার তাঁদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে প্রায় ১০ বছর ধরে অনেকটা নিষিদ্ধ অবস্থায় আছে। জামায়াতের প্রভাবাধীন আর্থিক ও সেবামূলক অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারি দলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কাছেও গুরুত্ব হারিয়েছে জামায়াত। এই অবস্থায় দলটির নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশের চাপ আছে বিএনপির কাছ থেকে সরে আসার। এর পরিপ্রেক্ষিতে দলটি বিএনপির কাছ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভাঙার দায় নিতে চাইছে না। তাই আপাতত জোটের বৈঠক ও কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকার কৌশল অবলম্বন করবে।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মিত্রতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু থেকেই সমালোচনা আছে। বিশেষ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের বিচার এবং ফাঁসির পর সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মীদের সহিংসতা দেশ-বিদেশে সমালোচিত হয়। তখন থেকে বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির ওপর চাপ বাড়ে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াতের বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে সামনে রেখেছে। জামায়াতের সঙ্গে জোট করায় বিএনপিকে আক্রমণ করে প্রায়ই বক্তৃতা দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোটের শরিক দলের নেতারা।
যদিও খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার আমলে (১৯৯১–’৯৬) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল। তার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। প্রায় ২০ বছর আগে, ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠন হয়। একসঙ্গে আন্দোলনের পর এই জোট ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পায় এবং সরকার গঠন করে। শুরুর দিকে চারদলীয় জোটের শরিক ছিল এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট ও জামায়াতে ইসলামী। একপর্যায়ে এরশাদ চার দল ছেড়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে গেলে জাতীয় পার্টির নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে দলটির একটি অংশ (যা পরে বিজেপি হয়) চার দলে থেকে যায়। চারদলীয় জোট পরে ২০-দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ধর্মভিত্তিক দল বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এই জোট ছাড়ে প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট। এর এক দশক আগে ২০০৬ সালে শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ বিএনপি জোট ছেড়ে যায়। অষ্টম জাতীয় সংসদ থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর একসঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে বিএনপি-জামায়াত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণে দল দুটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার পর এই দূরত্ব আরও বাড়ে, যা এখন বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী দল। তাদের জোটে রাখাটা আমি কখনো পছন্দ করিনি, এ কথাটা সব সময় বলে আসছি। এখন যদি তারা বেরিয়ে যায়, সেটা তাদের ইচ্ছা। তবে আমি বলব, বিএনপি তাদের আশ্রয় দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।