সভ্যতার বিবর্তন, কালের পরিবর্তন, যুগের পরিবর্তনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার আদিম ঐতিহ্য এক সময়ের নির্ভরযোগ্য আলোর দিশারী রাত্রিকালীন বন্ধু ”হারিকেন“। আবহমান বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে সে কালে ছিলো না কোন বিদ্যুৎতের আলো, ছিলো না কোন আধুনিক বিজ্ঞানের ছোঁয়া।প্রথম হারিকেনের বর্ণনা পাওয়া যায় আল রাযী এর বই "কিতাব আল আছার"। যেখানে তিনি একে নাফতা বলে উল্লেখ করেন।"হারিকেন" টিমটিমে আলোয় কি এক নৈসর্গিক ছায়া। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি নিদর্শন। কত যে গল্প, কবিতা আর উপন্যাসে হারিকেনের উপমা ব্যবহার হয়েছে তার শেষ নেই।
হারিকেন নিয়ে যত কবিতা ছড়া, গল্প রয়েছে-
“এক্কা-দোক্কা প্রহর, বউছি, ডাংগুলি, হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট/
নিভু নিভু আলো, গা ছমছম নিকষ আঁধার, কুয়াশা টুপটাপ শব্দ/
ফিরে আসে বারবার অন্তরে জাজ্বল্যমান হয়ে, না ফেরানো বেলা/
কখনো ভোরে কখনো দুপুরে কখনো বিকেলে শান্ত পরিবেশে/
ফিরে সেই হারিক্যান সন্ধ্যা, ফিরাতে জানায় নি:শব্দ আহূতি....”
একটা সময় ছিল যখন গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে হারিকেন দেখা যেত। তখন হারিকেন মেরামত করতে বিভিন্ন হাট বাজারে মিস্ত্রী বসতো। উপজেলার প্রতিটি বাজারে ছিল হারিকেন মেরামত করার অস্থায়ী দোকান। তারা বিভিন্ন হাট বাজার ঘুরে ঘুরে হারিকেন মেরামতের কাজ করতেন। এছাড়া অনেকে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়েও হারিকেন মেরামত করতেন। কিন্তু এখন আর হারিকেনের ব্যবহার তেমন একটা না থাকার ফলে হারিকেন মিস্ত্রীদেরও আর দেখা যায় না।
একসময় ছিলো যখন গ্রামের দোকানে কেরোসিন বিক্রির লাইন পরতো মাগরিবের নামাজের আগে, কেননা মহিলারা সন্ধ্যার আগেই হারিকেন প্রস্তুত করতো। রাত জেগে ধান ভানতো, ঢেঁকি চালাতো এই হারিকেনের আলোয়। তেল যখন কমে আসতো তখন দেখা যেত আলোও কমে আসছে। তেলের উপর নির্ভর করতো আলোর পরিমাণ। কিন্তু আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হ্নদয় নিয়ে বলতে হয় এক সময়ের আঁধারে আলোর সাথী হারিকেন বিদ্যুতের দাপটে হারিয়ে গেছে।এখন আর হারিকেন দেখা যায় না। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। রাস্তা-ঘাট, হাঁট-বাজারে এখন বিদ্যুতের দাপট। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে জাতির কল্যাণ বয়ে এনেছে। তবে হারিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
গ্রামের পর গ্রাম এখন বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত হয়ে গেছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে অজ পাড়া গ্রাম গুলো এখন পল্লী শহরে রুপান্তরিত হয়েছে। কাজেই সেকালের ঐতিহ্যবাহী হারিকেনের আলোর প্রয়োজন আর প্রয়োজন হচ্ছে না।বর্তমানে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যাপক প্রসারে কমে গেছে হারিকেনের চল। এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের মতো টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে হারিকেন। বিদ্যুতের প্রসার, বিদ্যুৎ চলে গেলে বিভিন্ন ধরনের চার্জার বাতির ব্যবহারে হারিকেনের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। তাই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী হারিকেন।
এক সময় দেখা যেতো হারিকেন হাতে নিয়ে ডাকপিয়ন ছুটে চলেছেন গ্রামের পর গ্রামে। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সবাই রাতের বেলাই হারিকেন হাতে নিয়ে বের হতেন। হারিকেনের আলো গৃহস্থালির পাশাপাশি ব্যবহার হতো বিভিন্ন যানবাহনে। কিন্তু আধুনিকায়নে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক বাতিতে বাজার ভরপুর। যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে রাত্রিকালীন আলোর একমাত্র উৎস ঐতিহ্যবাহী হারিকেন।
সত্তর বছর বয়সী হাজী আঃ করিম বলেন, হারিকেন দিয়ে আমরা ১৯৬৬ সালে লেখাপড়া করেছি।১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রাতের অন্ধকারে হারিকেনকে আলোর দিশারি হিসেবে সাথে নিয়ে নিজ বাড়ী থেকে নানীর বাড়িতে নিরাপদে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলাম।প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে হারিকেনের ব্যবহার এখন দেখি না বললেই চলে।বাসুদেবকোল গ্রামের মুঞ্জুরুল হাসান বলেন,একসময় আমরা রাত্রিকালীন সময়ে মাছ ধরতে যেতাম। আলোর দিশারী হিসাবে সাথে হারিকেন নিতাম।এটি আমাদের পরম বন্ধুর মতো সাহায্য করেছে। এখন আমাদের চরাঞ্চলে হারিকেনের ব্যবহার তেমন একটা নেই বললেই চলে।
রুলিপাড়া গ্রামের ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া ছাত্র সাব্বির রহমান জানান,আমি হারিকেনের আলোয় কখনও পড়াশোনা করিনি।দাদা হারিকেন সম্পর্কে আমাদের মাঝে গল্প বলতো।যা শুনে রুপকথার গল্পের মতো মনে হয়।সময়ের আবর্তে এক সময় হারিকেন দেখতে যেতে হবে জাদুঘরে। নতুন প্রজন্ম হয়তো জানবেও না হারিকেনের ইতিহাস।বইয়ের পাতায় খুঁজবে হারিকেনের ইতিহাস।
এক সময় হয়তো চিরতরে বিলুপ্ত হবে হারিকেন। তাই হারিকেন নিয়ে ছন্দের সুরে বলা যায়ঃ-
"যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি" "এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি"