২০২০: আদর্শলিপি যেন ভুলে না যাই

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: সোমবার ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৫৯ অপরাহ্ন
২০২০: আদর্শলিপি যেন ভুলে না যাই

আশির দশকে “আদর্শ লিপি” বই দিয়ে শুরু হতো শিশুদের বর্ণমালা শেখা। সে সময় শিক্ষকদের নানান নীতি বাক্য শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। যেমন: অ-তে ‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো, আ-তে আলস্য দোষের আকর, ই-তে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, উ-তে উদার মনের মানুষ হব, সবার দুঃখে পাশে রব’। প্রায় তিন দশক পেরিয়ে আমরা এখন বিংশ শতাব্দীর দোড়গোড়ায় দাড়িয়ে। মাত্র ১ দিন বাকী। আসছে ২০২০ সাল। এই তিন দশকে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। 

দেশ ও সমাজ এখন উন্নতির পথে। বিশ্ব এখন মানুষের হাতের নাগালে। তবে নেই সেই নীতিবাক্য। আর আদর্শলিপি বই বাদ দিয়ে এখনকার প্রজন্ম বিদেশী সংস্কৃতি, ভীনদেশী ভাষার চর্চায় মগ্ন। হবে-ই বা না কেন? প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অভিভাবকরাই তাদের সন্তানদের শিশুকাল থেকে প্রস্তুত করার জন্য ইংলিশ মিডিয়াম তথা ডিজিটাল মাধ্যমে গড়ে তোলার যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে আমাদের সন্তানদের শিশু বয়সেই মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয় এ্যানো-ত্যানো-হ্যানো....। এতে করে উন্নত জাতি গঠনের বিপরীতে ধ্বংসের পথে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। 

কেননা কথায় আছে, অতি লোভে তাতী নষ্ট। মা-বাবার উচ্চাকাঙ্খী মনোভাবের কারণে অনেক শিশুই মেধা বিকাশের পরিবর্তে মেধা শূণ্য হয়ে পড়ছে। অবশ্য ব্যতীক্রমও আছে। বর্তমানে আমাদের শিশুরাই বিজ্ঞানভিত্তিক নানান আবিস্কার করছে যা দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজে আসবে। তবে এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাড়াতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাড়াতে হবে সচেতনতা।

আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও দেখা যেত অনৈতিক কাজে কেউ জড়িত থাকলে তাকে অনেকেই এড়িয়ে চলতেন। এমনকি যিনি অন্যায় বা অপরাধ করতেন, তিনি নিজেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যদের এড়িয়ে চলতেন। অন্যদিকে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতেন। বয়স্ক ব্যক্তি, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, আইন কর্মকর্তাদের সবাই সম্মান করতেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দোড়গোড়ায় এসে আমাদের খুঁজতে হয় সম্মান ও নীতির ব্যাপারটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব বা এর প্রয়োজনীয়তা আছে কি- নেই।

একসময় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা, আদর্শ, আচার-আচরণ শেখানো হতো। অথচ এখন সংবাদ মাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর যৌন হয়রানির ঘটনা। শিক্ষক যখন এ রকম কুকর্মে লিপ্ত থাকেন, সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শেখার সুযোগ কোথায়? এছাড়া অভিভাবক যখন তাঁদের ছেলেমেয়েকে অনৈতিক পন্থায় পরীক্ষায় পাস বা সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য সমর্থন করেন, তখন ছেলেমেয়েদের মধ্যে নৈতিকতার কোনো বিকাশ হবে না, এটাই স্বাভাবিক।

রাস্তাঘাট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসাÍএমন একটা খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নৈতিকতা চরমভাবে বিপর্যস্ত নয়। কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, আমজনতা কেউ বাদ নেই। পুরো সিস্টেম একটা সিন্ডিকেটে হয়ে গেছে। অনেকে আবারা চাইলেও এই সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছেন না। কেউ কেউ আবার ইচ্ছা করেই বের হতে চাইছেন না। এত সহজে অনেক টাকা উপার্জনের সুযোগ সহজে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

যৌবন তো বাধা বন্ধনহীন। তাতে উদ্দামতা আছে। সব সমাজেই আছে। কিন্তু সেই যৌবনকে যদি কৈশোর থেকে একটি সঠিক খাতে প্রবাহিত করা যায়, তবে ঐ উম্মাদনা কল্যাণমুখী হয়ে ওঠে, ধ্বংসাত্মক নয়। কিন্তু এখন অপরিচর্যায় তা পঙ্কিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। যে ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের সকল ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, সে ছাত্ররাজনীতি এখন এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এই রাজনীতি থেকে আদর্শ উধাও। ফলে তা অর্থবিত্ত-ভোগবিলাসের বাহনে পরিণত হয়েছে। ছাত্ররা নিয়োজিত হয়েছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও নারী নির্যাতনের নষ্ট উৎসবে।

বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের একটি উন্নয়শীল দরিদ্র দেশ। বেকারত্বের কারণে এদেশের দারিদ্রের অভিশাপ দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। গ্রাম ও শহরে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ যখন স্বাভাবিকভাবে উপার্জন করতে না পারে তখনই অপরাধের পথ বেছে নেয়। ফলে দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা ইত্যাদির মত অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমান বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলীর মধ্যে মাদক অন্যতম। সংবাদপত্রের জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, নেশাগ্রস্থ ও অবৈধ চোরাচালান ব্যবসার সাথে জড়িত শতকরা নববই জন তরুণ-তরুণী ও কর্মসংস্থানহীন বেকার যুবকরা। শহরের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যুবক ৬০% এবং যুবতী ৫০%-এর বেশি নেশাগ্রস্থ। শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সর্বোচ্চ জ্ঞান কেন্দ্রের ছাত্রীরাও জড়িয়ে পড়েছে নেশার জগতে। আর নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে গণিকাবৃত্তিকে। যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য এরচেয়ে ভয়াবহ আর কী হতে পারে? ধনী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অভিভাবকের কাছ থেকে পড়াশুনার খরচ বাবদ টাকা নিয়ে তা ব্যয় করছে নেশার দ্রব্য কিনতে। টাকা না পাওয়ার কারণে সুশিক্ষিত কন্যার হাতে বাবা-মায়ের হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাংক কর্মকর্তার হাতে প্রাণ হারিয়েছে স্ত্রী ও পুত্রসন্তান, স্ত্রী তার বন্ধুদের নিয়ে হত্যা করেছে ব্যবসায়ী স্বামীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে খুন করে ঘরের মধ্যে লাশ পুঁতে রেখে নির্দয়তার প্রমাণ রেখেছে এবং নেশাগ্রস্ত কন্যা হত্যা করেছে নিজের পিতা-মাতাকে। মাদকতার এ রকম ভয়াবহ পরিণতি নৈতিকতাকে সত্যিই আজ হুমকির সম্মুখীন করেছে। অপরদিকে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা ছুটছে রাজনীতির ছায়াতলে। কেননা বর্তমান সমাজে যুবক-যুবতীতের একটি সহজ ধারণা রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেই অর্থ আয় করা যায়। এছাড়া মাদক বিক্রি করে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রবণতাতো আছেই। যার প্রমান বিগত বছরগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মাদকসহ আটকের সংখ্যা।

আমরা জানি, সবসময়ই তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তরুণেরা কীভাবে গড়ে উঠছে, কীভাবে বেড়ে উঠছে, কীভাবে ও কী শিক্ষা গ্রহণ করছে তার ওপর নির্ভর করে সংশি¬ষ্ট রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী হবে। সে রাষ্ট্র প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে উত্তীর্ণ হবে, নাকি পিছিয়ে পড়বে। নাকি স্থবির হয়ে পড়ে থাকবে। সে কারণেই তরুণ প্রজন্ম নিয়ে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে ভাবতে হয়। তবে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, তরুণ প্রজন্ম বেড়ে ওঠার ব্যাপার নয়, সর্বাঙ্গীন পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের গড়ে তুলতে হয়। দরকার হয় যতœ ও পরিচর্যার। সেটা যদি আমরা না করতে পারি তবে তরুণ প্রজন্মে বিনাশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। যা গোটা জাতির জন্য এক মহাসর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত কয়েক দশক ধরে সেই যতœ ও পরিচর্যার ঘাটতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অবক্ষয় অধঃপাতে যেতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। এ থেকে বেড়িয়ে আসতে দরকার ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সকলের সম্মিলিত প্রয়াস। এমন কি নতুন প্রজন্মকেও আমরা যদি বোঝাতে সক্ষম হই যে, তাদের অবক্ষয় দেশের ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চিত করে তুলতে যাচ্ছে। তা হলে অবক্ষয় রোধের লড়াইয়ে তারাও শরিক হবেন। 

ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আহবান সেই তিন দশক আগের ‘আদর্শলিপি’ অনুসরণ করে আসুন এগিয়ে চলি, “স-তে সজ্জন দেখে সখ্য গড়ি, সততায় নিই হাতেখড়ি। এ-তে একতা হল শক্তির মূল, একলা চলে করো না ভুল। ঘ-তে ঘৃনায় যা কখনো নয়, ভালবাসায় তা হয় জয়। ঔ-তে ঔদ্ধত্য ভাল নয়, বিনয় দিয়ে করব জয়। গ-তে গর্ব করি দেশের জন্য, ভালোবেসে হই ধন্য। র-তে রক্ষা করি জাতির মান, ন্যায়বিচারে সবাই সমান। শ-তে শপথ নিলাম দৃপ্তহাতে, বাঁচার লড়াই একসাথে। হ-তে হঠকারীদের দিন শেষ, সবাই মিলে গড়ি ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ’।
লেখকঃ বার্তা সম্পাদক-দৈনিক আজকের সুন্দরবন ও সহ-সভাপতি, নিউজ এডিটরস্ কাউন্সিল, বরিশাল। 

ইনিউজ ৭১/এম.আর