বিডিআর বিদ্রোহের নামে ২০০৯ সালে পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানসহ অন্যান্য সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাতে এ প্রতিবেদন তুলে দেন। দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এ ঘটনার তদন্ত-উপসংহার জাতীয় পর্যায়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে ছিল। সত্য উদ্ঘাটনে কমিশন যে ভূমিকা রেখেছে—জাতি তা স্মরণে রাখবে।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রতিবেদনে বহু মূল্যবান শিক্ষা এবং দীর্ঘদিনের প্রশ্নের উত্তর রয়েছে, যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।”
ধ্বংস হওয়া আলামত, বিদেশে পলাতক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি
কমিশন প্রধান ফজলুর রহমান জানান, ১৬ বছর আগের একটি ঘটনার আলামত সংগ্রহ করা ছিল কঠিন। অনেক প্রমাণ ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দেশে নেই। দীর্ঘ সময় এবং পেশাদারি নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা দুই ধাপে সাক্ষ্যগ্রহণ ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। কোনো কোনো সাক্ষীর বক্তব্য তাঁরা আট ঘণ্টা পর্যন্ত শুনেছেন।
তদন্তে উঠে এসেছে ভারত, আওয়ামী লীগ নেতাদের সংশ্লিষ্টতা
সবচেয়ে আলোচিত অংশ হলো—এই হত্যাযজ্ঞে বহিঃশক্তি তথা ভারতের “সরাসরি সম্পৃক্ততা”র প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে কমিশনের মন্তব্য। কমিশন মনে করে, ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করতে এবং দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে এ ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। তারা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে—ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য চাওয়া উচিত।
কমিশন সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার জানান, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। এর পেছনে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে উঠে এসেছে তৎকালীন সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম। তাঁর দাবি—ঘটনার আগে এবং ঘটনার দিন আওয়ামী লীগ–সম্পৃক্ত একটি মিছিল পিলখানায় প্রবেশ ও বের হয়, যা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রমাণ বহন করে।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পাওয়া গিয়েছিল—যা ঘটনার পেছনে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে ইঙ্গিত করে।
কেন সেনাবাহিনী অভিযান চালায়নি?
এ প্রশ্নে কমিশনপ্রধান জানান, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তাঁদের বলেছেন—সেনাবাহিনী পিলখানায় অভিযান চালালে ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারত। ওই ঝুঁকির কারণেই সেনাবাহিনী অপেক্ষমাণ ছিল। কমিশনপ্রধানের মতে, এটি সেনাবাহিনীর একটি বড় কৌশলগত সিদ্ধান্ত হলেও “ব্যর্থতা”র প্রশ্নও ওঠে।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল ‘পর্বত পরিমাণ’
কমিশন জানায়, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, র্যাব—সব জায়গায় ব্যাপক ব্যর্থতা ছিল। র্যাবের সদস্যরা ঘটনাস্থলের খুব কাছে অবস্থান করেও নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন, ফলে তাঁরা কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। কমিশন তাদের এই স্থবিরতার তীব্র সমালোচনা করেছে।
২০০৯ সালের তদন্তের সঙ্গে বর্তমান তদন্তের পার্থক্য
শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তাদের রিপোর্টে উঠে এসেছিল যে বিডিআরের একটি অংশ ২০০৭ সাল থেকেই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিল এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাদের গোপন বৈঠক ছিল। কিন্তু সেই সময় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়নি—যা বর্তমান কমিশন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
৯২১ ভারতীয় প্রবেশ, ৬৭ জনের সন্ধান নেই
তদন্তে আসে—ঘটনার সময় বাংলাদেশে ৯২১ ভারতীয় নাগরিক প্রবেশ করেছিল। এর মধ্যে ৬৭ জনের বের হওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। কেউ প্লেনে ঢুকে ট্রেনে বের হয়েছে, কেউ ট্রেনে ঢুকে অজানা পথে দেশত্যাগ করেছে। এ তথ্যকেও ভারতের সংশ্লিষ্টতার একটি শক্তিশালী ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে কমিশন।
কমিশন সেনাবাহিনীর কাঠামো, বিজিবির অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধান, গোয়েন্দা সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্তব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করেছে।