প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ১২:৩৯
বাংলাদেশ ভারতের প্রস্তাবিত ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলতি বছর শুরু হয়ে ২০২৮ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকলেও গ্রিড নিরাপত্তা, পরিবেশগত ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশ এই প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পার্বতীপুর থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বোরানগর এবং বিহারের কাটিহার পর্যন্ত ৭৬৫ কেভি ক্ষমতার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কথা ছিল। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে দেশের অন্যান্য অংশে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ ভূমিকা রাখার প্রস্তাব ছিল। ২০২৩ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির সভায় দুই দেশের সঞ্চালন সংস্থাগুলো অংশগ্রহণ করে একটি সিদ্ধান্ত হয়। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) কিছু প্রস্তাবিত রুটের মধ্যে বোরানগর-পার্বতীপুর-কাটিহার রুটটি চূড়ান্ত করে। তবে পিজিসিবিসহ বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীরা এই প্রকল্পের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
একদিকে গ্রিড সংযুক্তির ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভ্রাট ভারতের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে, অন্যদিকে ভারতে কোনো ব্ল্যাকআউট হলে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ আরও বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যেখানে সর্বোচ্চ চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট, তাই অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ঋণ নিয়ে প্রকল্প নেওয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা।
পরিবেশগত প্রভাবেও প্রকল্পটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর ভারতীয় অংশের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহের পরিকল্পনা থাকায় এতে বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া, নদী ভাঙন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া এবং কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য এত বিশাল আর্থিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। প্রকল্প অনুমোদনের আগে স্বচ্ছতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চ রাখতে হবে। বর্তমানে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে, যার একাংশ সরকারি-বেসরকারি চুক্তির মাধ্যমে এবং কিছু অংশ আদানি গ্রুপের সরবরাহ। সম্প্রতি নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে, যা ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে। নেপালের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিতে ভারতের করিডোর সরবরাহের শর্ত নেই, তাই ভারতের বিদ্যুৎ করিডোর বাতিল হলেও নেপালের বিদ্যুৎ আমদানি প্রভাবিত হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বর্তমানে প্রকল্প অনুমোদনের বিষয়টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে ব্যাপক পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
এভাবেই বাংলাদেশ ভারতের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ করিডোর প্রকল্প বাতিলের পথে এগোচ্ছে, যেখানে দেশের নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে প্রধান বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।