গ্যাস চুরি: মাসে লোপাট সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: সোমবার ২৩শে মে ২০২২ ০৯:৫১ অপরাহ্ন
গ্যাস চুরি: মাসে লোপাট সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা

মাসে প্রায় ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে যার দাম (আমদানি মূল্যে) সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা প্রায়। চুরির পুরোটাই সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।


চুরি পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ কমানো গেলেও স্পর্ট মার্কেট এলএনজি আমদানি করতে হয় না। আর স্পর্ট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি করতে না হলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। মুনাফায় থাকা গ্যাসের ৬টি বিতরণ কোম্পানি দাম না বৃদ্ধি করে বিদ্যমান বিতরণ চার্জ বাতিল (ঘনমিটার ২৫ পয়সা) করলেও চলে ( সূত্র বিইআরসি করিগরি কমিটি)।


বাংলাদেশ বর্তমানে দৈনিক কমবেশি ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত জুলাই-ডিসেম্বর সিস্টেম লস হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। দৈনিক সিস্টেম লসের পরিমাণ ২৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কারিগরি ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস ধরা হয় সর্বোচ্চ ২.২৫ শতাংশ। বিতরণে ২ শতাংশ সঞ্চালনে দশমিক ২৫ শতাংশ।


বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল গণশুনানিতে বলেছেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস নেই। সাড়ে ৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়। এই মাত্রা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।


অর্থাৎ প্রায় ৬ শতাংশ চুরিকে সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দৈনিক চুরি যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে চড়াদামে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট। স্পর্ট মার্কেটের এলএনজির মূল্যের (ঘনমিটার ৫০ টাকা আমদানি শুল্কসহ) সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক চুরি যাওয়া ৬ শতাংশ গ্যাসের মূল্য দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটিতে। যা বছরে ১ লাখ ৩ হাজার ৫’শ কোটি টাকার মতো।


এই চুরির পরিমাণটি সরল অংকের হিসেবে। আরেকটি অংক রয়েছে, আবাসিকের মিটারবিহীন ৩৪ লাখ গ্রাহক। মিটারবিহীন গ্রাহকরা মাসে ৪০ ঘনমিটারের নিচে ব্যবহার করলেও প্রতিমাসে ৭৮ ঘনমিটারের বিল দিয়ে আসছে।


বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছিলেন, “প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের পাইলট প্রকল্পের রেজাল্ট খুব ভালো। দুই চুলায় মাসে ৩৩ ঘন মিটার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে”।


জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে দেশে বৈধ আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৩ লাখ ৬৮ হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে সাড়ে ৩৪ লাখ গ্রাহকের পকেট কাটা হচ্ছে। মাসে গড়ে ৫’শ টাকা হারে ধরলেও মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বছরে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই টাকার কারণে সিস্টেম গেইন করার কথা অর্থাৎ প্রকৃত সিস্টেম লসের পরিমাণ ১২ শতাংশের উপর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে।


এই চুরির প্রায় পুরোটাই বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অধিভুক্ত এলাকায়। অল্প পরিমানে রয়েছে কুমিল্লা চাঁদপুর অঞ্চলে বিতরণ কোম্পানি বিজিডিসিএল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি কেজিডিসিএল'এ। তিতাসের চুরি এখন ওপেট সিক্রেট। কোম্পানিটি সম্প্রতি চাপের মুখে জোনগুলোকে পৃথক করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে বেশকিছু জোনে পৃথক মিটার বসানো হয়েছে।   নারায়নগঞ্জ আড়াইহাজার জোনে প্রায় ৩০ শতাংশের উপরে সিস্টেম লস ধরা পড়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।


তবে এ তথ্য সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, কে দিয়েছে এই তথ্য? তার কাছে প্রকৃত তথ্য জানতে চাইলে বলেন আমি মুখস্ত বলতে পারবো না। জোন কতটি সে বিষয়েও আমার মুখস্ত নেই।


তিতাস গ্যাসের পরিচালক অপরেশন (চলতি দায়ত্বি) প্রকৌশলী সেলিম মিয়া যেনো এক কাঠি সরেস। তার কাছে সিস্টেম লসের কথা জানতে চাইলে বলেন, সাংবাদিক কি এই তথ্য চাইতে পারে। আপনার এই তথ্য দিয়ে কি দরকার। আপনি কোন এলাকায় গ্যাস থাকবে, কোন এলাকায় থাকবে না এটা জানতে চাইতে পারেন। সিস্টেম লস কি দরকার।


গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে পেট্রোবাংলা বলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। স্পর্ট মার্কেট থেকে চড়া দরে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তাদের তথ্যে দেখা গেছে গত অর্থবছরে গড়ে দৈনিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। সে হিসেবে স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। এ জন্য ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে বিইআরসি কারিগরি কমিটি ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। যে কোন দিন ঘোষণা আসতে পারে।


ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, বর্তমানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য আত্মঘাতি হতে পারে। আমরা মনে করে চুরি ঠেকানো গেলে স্পর্ট মার্কেট থেকে গ্য্যাস আমদানির প্রয়োজন পড়ে না। তখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর বদলে কমানো যায়। আমরা হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছি গ্যাসের দাম ১৬ পয়সা কমানো যায়।


গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিটি এমন সব দুর্নীতি সামনে এসেছে যা পুরোপুরি অভিনব। বৈধ সংযোগ বন্ধ, তখন সংযোগ দেওয়া হয়েছে, সেসব গ্রাহকের আস্থা সৃষ্টি করার জন্য কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে। যথারীতি গ্রাহকরা বিলও জমা করেন। ২০১২ সালে এ রকম পে-স্লিপের মাধ্যমে ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকা জমা পড়ে। তিতাসের আবাসিক গ্রাহকেরা যেসব ব্যাংকে প্রতি মাসে গ্যাসের বিল জমা দেন, সেই ব্যাংকগুলো থেকে ওই বাড়তি টাকার হিসাব কোম্পানির কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে আসে। কিন্তু এই টাকা তিতাসের হিসাবে জমা হচ্ছিল না (পোস্টিং না হওয়া) তাই বেকায়দায় পড়ে তিতাস। আর তখনেই বিষয়টি সামনে চলে এলে তখন বিষয়টি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।


এরপর আরেকটি অভিনব ঘটনা ঘটে, গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার। রাতের আধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার অভিযোগে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে মামলা করে তিতাস। প্রাথমিকভাবে এক রাতেই ১ হাজার ২৪৭টি সংযোগ বৈধ করে দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলাটি (৭ সেপ্টেম্বর ২০২০) দায়ের করা হয়।


আবার এমন ঘটনা ঘটেছে গ্রাহকরা বিল জমা দিয়েছেন কিন্তু সেই বিল জমা হয়নি লেজারে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রাহকদের এসব টাকা মেরে দিয়েছেন। আর ঘটনাটি ধরে পড়ে বকেয়ার দায়ে লাইন কাটতে গেলে। গ্রাহক তখন তাদের জমার রশিদ দেখান। এই ঘটনাটি ধরা পড়েছে গত জানুয়ারি মাসের দিকে।


সম্প্রতি আরেকটি হাস্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বিতর্কিত এই কোম্পানিটি। বাহবা নেওয়ার জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার খবর বিজ্ঞপ্তি পাঠায় মিডিয়াতে। গত ২৫ মে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তিতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) গ্রামের নাম লেখা হয়। কিন্তু গ্রামবাসি দাবী করেছেন তাদের এলাকার কখনও লাইন ছিল না। তাহলে কাটলো কিভাবে। এই ঘটনায় বেশ হাস্যকর ঘটনার জন্ম দেয়। অন্যদিকে কেজি মেপে ঘুষ খাওয়ার ঘটনাও তিতাসের সৃষ্টি।


দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাসে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। ‍দুদক গ্যাস-সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, অবৈধ সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং করা, কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো এবং বাণিজ্যিক গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়াসহ ২২টি বিষয়কে প্রতিষ্ঠানটিতে দুর্নীতির উৎস বলে চিহ্নিত করেছে।


গ্যাসের দাম ‍বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, তিতাসের এতো বদনাম, আমরা কাজ করতে পারছি না। হয়তো ৫-১০ শতাংশ স্টাফ দুনীতিতে জড়িত থাকতে পারে।


তিনি আরও বলেন, অনেক বলেন অবৈধ সংযোগ রয়েছে তিতাস কিছু করে না। আমাদের হাজার হাজার লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। আমরা কাটছি, তারা আবার লাগাচ্ছে। ইদুর বিড়াল খেলা চলছে, আমাদের লোকবল কম তাদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। অবৈধ প্রতিরোধে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।