জনবল সংকটে চলছে রাজবাড়ীর রেলওয়ে কার্যক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: রবিবার ১৪ই আগস্ট ২০২২ ১২:১১ অপরাহ্ন
জনবল সংকটে চলছে রাজবাড়ীর রেলওয়ে কার্যক্রম

জনবল সংকটে চলছে রাজবাড়ী রেলওয়ে সেকশনের কার্যক্রম। ফলে বন্ধ রয়েছে জেলার অনেক রেলওয়ে স্টেশন। যেকারণে বন্ধ থাকা স্টেশনগুলো থেকে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা না থাকায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।


রাজবাড়ী রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রাজবাড়ী-গোয়ালন্দ ঘাট, রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী-ভাঙ্গা, রাজবাড়ী-ভাটিয়াপাড়া, রাজবাড়ী-রাজশাহী রুটে প্রতিদিন পাঁচটি ট্রেন ১৪ বার আসা যাওয়া করে। গোয়ালন্দ ঘাট-কুষ্টিয়া রুটে ১৪ টি স্টেশনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গোয়ালন্দ বাজারসহ পাঁচটি রেল স্টেশনে কোনো কর্মকর্তা কর্মচারী নেই। রাজবাড়ী থেকে ভাঙ্গা ৬৪ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন রয়েছে ১২টি। এর মধ্যে স্টেশন মাস্টার আছে পাঁচটিতে। এ রুটে খানখানাপুর, বসন্তপুর, অম্বিকাপুর, ফরিদপুর কলেজ, বাখুন্ডা, তালমা ও পুকুরিয়া স্টেশনে মাস্টার নেই। রাজবাড়ী-ভাটিয়াপাড়া ৯৪ কিলোমিটার রেলপথের ১৭টি স্টেশনের মধ্যে ৯টিতে কোনো মাস্টার নেই। এ স্টেশনগুলো হলো রামদিয়া, আড়কান্দি,  নলিয়া গ্রাম, ঘোড়াখালী, সাতৈর, বোয়ালমারী, সসরাইল, বনমালীপুর ও ব্যাসপুর।


উল্লেখিত স্টেশনগুলোতে বুকিং সহকারী পদও শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন যাবৎ। বন্ধ থাকা এসব স্টেশনে শুধু ট্রেন থামে। নেই আর কোনো কার্যক্রম। ট্রেনের সময় সূচি অনুযায়ী আপ-ডাউন কাছাকাছিতে রয়েছে কয়েকটি ট্রেন। অনেক ক্ষেত্রেই  দিতে হয় ক্রসিং। বন্ধ থাকা স্টেশনগুলোতে ক্রসিং দেওয়ার সুযোগ না থাকায় ট্রেন ক্রসিংয়ে সময় লাগে অনেক বেশি। যেমন, রাজবাড়ী থেকে কালুখালীর মধ্যে রয়েছে সূর্যনগর ও বেলগাছি স্টেশন। এ দুটি স্টেশনই বন্ধ। মাঝে মধ্যেই খুলনা থেকে ছেড়ে আসা নকশী কাঁথা মেইল ট্রেন কালুখালী এসে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। কারণ, একই সময়ে রাজবাড়ী থেকে ভাটিয়াপাড়াগামী কালুখালী ভাটিয়াপাড়া মেইল ট্রেনটি গিয়ে থাকে। আবার দুপুরে নকশী কাঁথা মেইল ট্রেন যখন খুলনা অভিমুখে যায় তখন পোড়াদহ থেকে গোয়ালন্দ ঘাটগামী সাটল ট্রেনের আসার সময়। হয় মেইল ট্রেনকে রাজবাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অন্যথা সাটল ট্রেনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কালুখালীতে। কিন্তু বেলগাছি স্টেশনটি চালু থাকলে দুদিক থেকেই সময় বাঁচতো। যাত্রীদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এছাড়াও বন্ধ থাকা স্টেশনগুলোতে কোনো টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা নেই। নেই মালামাল বুকিংয়ের কোনো ব্যবস্থাও। যাত্রীরা টিকিট কাটতে পারছে না। ব্যবসায়ীরাও তাদের পণ্য বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে পাঠাচ্ছেন।


সরেজমিন রাজবাড়ী সদর উপজেলার সূর্যনগর রেল স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের আশপাশে নোংরা আবর্জনায় ভরা। দেখে মনে মনে হবে কোন পরিত্যাক্ত স্থাপনা।  স্টেশনে নেই কোন প্লাটফর্ম। স্টেশনের ভবনের অবস্থা জরাজীর্ণ। অনেক খুটিই নষ্ট হয়ে গেছে। দরজা জানালা খুলে খুলে পড়ছে। নেই যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা। স্টেশনের কক্ষে ঝুলানো রয়েছে তালা। টিকিট কাউন্টারের সামনে একটি চৌকি পাতা রয়েছে তার ওপরে একটি ছাগল শুয়ে আছে। পাশেই একটি বেঞ্চে দুইজন ব্যক্তি দাবা খেলায় ব্যস্ত। এরই মধ্যে কুষ্টিয়া থেকে শাটল ট্রেনটি এসে থামে স্টেশনে তবে ট্রেন আসার আগে বাজেনি কোন ঘন্টা। এমনকি যাত্রীরা ট্রেনে উঠার আগে কোন টিকিটও কাটেনি।


এই উপজেলার বেলগাছি স্টেশন গিয়ে দেখা যায়, স্টেশন মাস্টারের কক্ষটি তালা বন্ধ। টিকিট কাউন্টারের কক্ষটিও রয়েছে তালা ঝুলানো। যাত্রীদের বিশ্রাম কক্ষটির অবস্থাও জরাজীর্ণ। সেখানে কয়েকজন যাত্রী বসে আছে ট্রেনের অপেক্ষায়। স্টেশন ভবনের বাইরে চেয়ার টেবিল নিয়ে ছাতার নিচে বসে আছে বেসরকারি ট্রেনের টিকিট বিক্রির জন্য দায়িত্বরত একজন। যাত্রীদের বসার জন্য জায়গা না থাকার কারণে স্টেশনের প্লাটফর্মের ওপরে হাটাহাটি করছে অনেকেই। অনেকেই আবার আশপাশের চায়ের দোকানসহ অনান্য দোকানের বেঞ্চে বসে আছেন।


স্থানীয় রফিক মৃধা বলেন, যাত্রীরা রাজবাড়ী যাবে, গোয়ালন্দে যাবে ট্রেনে ওঠার মত কোন ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টি হলে স্টেশনের বসার কোন জায়গা নেই। টিকিট কাটার মত কোন জায়গা নেই। গাড়িতে উঠলে জরিমানাসহ টিকিট কাটতে হয়। যদি স্টেশন মাষ্টার থাকতো, প্লাটর্ফম মেরামত করতো, যাত্রীদের বসবার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সবাই সুবিধা পেতো।


মাসুম খান নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, রাজবাড়ী জেলার স্টেশনগুলো একসময় খুবই জমজমাট ছিলো। যাত্রীদের বসার সুব্যবস্থা ছিলো, স্টেশন মাষ্টার ছিলো, পটার ছিলো, মাল বুকিংয়ের ব্যবস্থা ছিলো, ট্রেন আসার আগে ঘন্টা বাজতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে কখন ট্রেন আসে আর কখন ট্রেন যায় সেটা যাত্রীরা জানে না। স্টেশনে কোন স্টেশন মাষ্টার নেই, পটার নেই, মাল বুকিংয়ের কোন ব্যবস্থা নেই, ঘন্টা বাজে না। অনেক স্টেশনের ভবন গুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। লোকবল সংকটের কারনে অনেক স্টেশনে ট্রেন থামে না। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার।


বেলগাছি স্টেশনে বেসরকারি ট্রেনের টিকিট বিক্রেতা মো. মাজেদ বলেন, সরকারি ট্রেনের কোন টিকিট বিক্রি হয় না। কারণ স্টেশন মাষ্টার নেই, টিকিট বিক্রেতা নেই। যে কারণে সরকারি ট্রেনের যাত্রীরা টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠে। বন্ধ থাকা স্টেশনগুলোতে শুধু মাত্র বেসরকারি খাতের ট্রেনের টিকিট বিক্রি হয়।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন টিটিই বলেন, রাজবাড়ী সেকশনে টিটিই রয়েছেন মাত্র চারজন। ট্রেন চলাচল করছে পাঁচটি। এর মধ্যে দুটি অবশ্য বেসরকারি খাতে রয়েছে। মাত্র চারজন টিটিই দিয়ে তিনটি ট্রেনের যাত্রী চেক আপ করা খুবই কষ্টকর। ফলে যাত্রীদের টিকিট কাটার ইচ্ছে থাকলেও টিকিট করতে পারে না। টিটিই সংকটের কারণে আমরাও  পৌঁছাতে পারি না সব যাত্রীর কাছে। ফলে অনেক যাত্রীই বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমন করছে।


সূর্যনগর রেলওয়ে স্টেশনের পটার মো. সবুর আলী মোল্লা, দীর্ঘ দিন ধরে তিনি এখানে পাহারাদার হিসাবে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, এখানে কোন টিকিট বিক্রি হয়না। যখন আমি প্রথম যোগদান করি এই স্টেশনে তখন আমি দুই তিন বছর টিকিট বিক্রি করেছিলাম নিজ দ্বায়িত্বে। এখন আর টিকিট বিক্রি হয়না। স্টেশনটার অবস্থাও খারাপ। বৃষ্টি হলে পানি পরে। সে সময় ছাতা নিয়ে রুমের মধ্যে বসে থাকতে হয়। যাত্রীদের বসার জায়গা নেই, বাথরুম নেই। সমস্যাগুলো উর্দ্ধতন কতৃপক্ষকে জানিয়েও কোন লাভ হয় নাই।


রাজবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন মাষ্টার তন্ময় কুমার দত্ত বলেন, রাজবাড়ী জেলায় অনেক স্টেশনে লোকবল সংকট বিরাজ করছে। যে কারণে অনেক স্টেশনের স্টেশন মাষ্টার না থাকায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সেই সাথে ট্রেন ক্রসিংয়েও সমস্যায় পরতে হচ্ছে। সময় মত ট্রেন না পৌছানোয় ভোগান্তিতে পরতে হচ্ছে যাত্রীদের। জনবল সংকটের কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।


বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (পাকশী) আনোয়ার হোসেন বলেন,  জনবল সংকটের কারণে বন্ধ থাকা স্টেশনে লোকবল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হলে সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব, তাছাড়া হবে না। এগুলো নতুন বন্ধ না, অনেক দিন ধরেই বন্ধ আছে। স্টেশন বন্ধ থাকায় সরকারের রাজস্ব হারানোসহ ট্রেন ক্রসিংয়েও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।