প্রবল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে সৌদি আরব

নিজস্ব প্রতিবেদক
ডাক্তার আরিফুর রহমান, বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক
প্রকাশিত: শুক্রবার ২৪শে এপ্রিল ২০২০ ০৬:৩০ অপরাহ্ন
প্রবল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে সৌদি আরব

গত কয়েক দশক সৌদি আরবের ভালো অর্থনীতির কারণে যেসব দেশের অর্থনীতির ইঞ্জিন রুম চালু ছিলো সেগুলি হচ্ছে, মিশর, সুদান, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশ, নেপাল, ফিলিপাইন। এই দেশগুলি এতদিন তাদের লক্ষ লক্ষ কর্মী প্রেরণ করেছে। সৌদি অর্থনীতির পতনে এই সব দেশগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই দেশগুলির কোন মানুষের সৌদি অর্থনীতির পতনকে স্বাগত জানানো উচিত নয়।

মিডল ইস্ট আই পত্রিকার সম্পাদক ডেভিড হিয়ার্স্ট সৌদি অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। আমি নিজে তার সব তথ্যের সাথে একমত না হলেও তিনি যা লিখেছেন তার সুরে সুরে মিলিয়ে অনেক পশ্চিমা পন্ডিতদের লেখা অনেকগুলি নিবন্ধ চোখে পড়লো যার সবগুলিই সৌদি আরবের অর্থনীতি নিয়ে হতাশা দেখানো হচেছ। 

যদি সবার ধারণা মূলক হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের এখনই সতর্ক হতে হবে। আমাদের বাইশ লক্ষ প্রবাসীদের নিয়ে অগ্রিম পরিকল্পনা করে রাখতে হবে এখনই। 

প্রকাশিত নিবন্ধে ডেভিড লিখেছেন, "সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যকার তেল যুদ্ধে হেরেছে সৌদি আরব। গত মাসে ওপেকের বৈঠকের প্রাক্কালে সৌদি উপ রাষ্ট্র-অধিপতি মোহাম্মদ বিন সালমান রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে এক ঝড়ো টেলিফোন কল দিয়েছিলেন। 

পুতিনের সাথে যে কেউ সাক্ষাত করেছেন, তিনি জানেন যে আপনি রাশিয়ান রাষ্ট্রপতির সাথে যতটা ইচ্ছা দর কষাকষি করতে পারেন। এমনকি আপনি সিরিয়া এবং লিবিয়াতে দুটি আঞ্চলিক যুদ্ধের বিরোধী গ্রূপের পক্ষেও থাকতে পারেন এবং তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়েপ এরদোগান যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন তেমনি একটি কার্যকর সম্পর্কও বজায় রাখতে পারেন। তবে আপনি যা করবেন না তা হ'ল পুতিনকে কোণঠাসা করা আর তাকে ফিরিয়ে দেওয়া। সৌদি মুকুট রাজকুমার পুতিনকে আলটিমেটাম দিয়ে এবং তাঁর সাথে চিৎকার করে কথা বলে এই কাজটাই তিনি করেছিলেন। 

এখন দেখা যাচ্ছে ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা জারেড কুশনারের বৃদ্ধাঙ্গুলি আপ সাইন পেয়ে এমবিএসের এই কলটি করা অনেক বড় ভুল ছিল। তেলের দাম ধসে গেছে, স্টোরেজ দ্রুত শেষ হবে এবং তেল সংস্থাগুলি তাদের কূপগুলিকে সম্ভবতঃ ক্যাপ করাতে বাধ্য হবে। 

ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ২০ ডলারেরও কম হওয়ায় সৌদি তেল বিক্রি কমে যাবে এবং সৌদি আরব ঋণ গ্রহীতার দেশ হওয়ার সম্ভাবনায় চলে আসল। আমেরিকা শুধু দশ পার্সেন্ট তেল কেনে সৌদি আরব থেকে।

বাদশাহ সালমান যখন ২৩ জানুয়ারী ২০১৫ সনে রাজা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তখন বিদেশী মুদ্রায় মজুদ ছিল মোট $ ৭৩২ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরব মুদ্রা কর্তৃপক্ষের (সামা) মতে, গত বছরের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯৯ বিলিয়ন ডলার,অর্থাৎ চার বছরে ২৩৩ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুসারে সৌদি জিডিপি মাথাপিছু ২০১২ সালে ২৫,২৪৩ ডলার থেকে কমে ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে $ ২৩,৩৩৮। 

খারাপ বিনিয়োগের একটি মাপকাঠি হ'ল সার্বভৌম সম্পদ বা সোভারিন ফান্ডের আপেক্ষিক মূল্য হ্রাস। 
সংযুক্ত আরব আমিরাত ১.২২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সোভারিন ফান্ডের মালিক, তারপরে কুয়েত $ ৫২২ বিলিয়ন ডলার, কাতার $ ৩২৮ বিলিয়ন ডলার এবং সেখানে সৌদিদের সবচেয়ে কম $ ৩২০ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনৈতিক পতনের আরেকটি পরিমাপ হল খারাপ বিনিয়োগ। জাপানের সফটব্যাঙ্কের সিইও মাসায়োশি সান স্মরণ করেছিলেন যে, এমবিএসের কাছে তিনি ভিশন তহবিলের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার চাইতে গিয়েছিলেন। মাত্র ৪৫ মিনিট মিটিং করে তিনি ৪৫ বিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন। "প্রতি মিনিটে এক বিলিয়ন ডলার"-- মাসায়োশি বলেছিলেন। সফটব্যাঙ্ক গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছে যে ভিশন তহবিল ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিতে পড়েছে। ২০১৭ সালে উবার টেকনোলজিতে সৌদি ইনভেস্টমেন্ট ধরা খেয়েছে। টেসলা স্টকটিও খুব রিস্কে আছে। 

মধ্যপ্রাচ্যের এক ব্যাংকার ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন," আমি বুঝতে পারছি না যে যখন তাদের নিজ দেশের জন্য প্রতিটি পয়সা দরকার তখন তারা কী করছে?" 

লকডাউনের সময় আর্থিক উদ্দীপনার ক্ষেত্রে সৌদি আরব জিডিপির এক শতাংশ ব্যয় করছে, অন্যদিকে কাতার ব্যয় করছে ৫.৫ শতাংশ, বাহরাইন ৩.৯, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১.৮। 

সৌদিদের টাকা কি ফুরিয়ে যাচ্ছে ? পর্যবেক্ষকরা কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন বোধক চিন্হ ঝুলিয়ে রেখেছে। বাদশাহ আদেশ দিয়েছিলেন যে করোনা বন্ধের সময় কর্মচারীরা ৬০ শতাংশ বেতন পাবে। টেলিকম সংস্থা এসটিসির কর্মচারীরা তাদের বেতনের মাত্র দশ শতাংশ পাচ্ছে। সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় হাসপাতাল হিসাবে চালানোর জন্য যে হোটেলগুলি অধিগ্রহন করেছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছেনা আবার তাদের রুমগুলি জীবাণুমুক্ত করার ব্যয় ছাড়াও রানিং কস্ট দিতেও বাধ্য করছে বলে অভিযোগ শোনা যায়।

আধুনিকীকরণ ও সংস্কারের পরিকল্পনার উভয় স্তম্ভই ভেঙে পড়ছে। বিদেশী স্টক এক্সচেঞ্জগুলিতে পাঁচ শতাংশ আরামকো শেয়ার বিক্রি করে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে এবং এখন তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বাইরে যাবার পিআইএফও পরিকল্পনা বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছে।

আমাদের আশা আছে সৌদি আরব বাংলাদেশে তাদের ঘোষিত ত্রিশ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করবে। আমরা আশা করি ডেভিড হিয়ার্স্ট যা লিখেছেন তা সবই ভুল। আল্লাহ সৌদি আরবকে ঠিক রাখুন আল্লাহ যেভাবে পছন্দ করেন সেইভাবে।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব