প্রায় দু’দশক পর আবারও সেনা অভ্যুত্থানের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানে। খাকি উর্দির ক্ষমতা দখলের আলামতও ভেসে উঠছে স্পষ্ট।দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অবহিত না করেই শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এক্ষেত্রে নিজের কার্যপরিধি, গণতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা, সরকারি প্রটোকল কিছুই তোয়াক্কা করেননি বাজওয়া। পরদিন ওই বৈঠকের খবর ফাঁস হওয়ায় সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখা আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) বিবৃতি দিয়ে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে।
পাকিস্তানের ডুবন্ত অর্থনীতি ভাসিয়ে তোলার রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই সেনাপ্রধান নিজ তাগিদে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেন বলে জানায় আইএসপিআর।এখানেই শেষ নয়, একইদিনে সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ ‘১১১ ব্রিগেডে’র ছুটি বাতিলের নির্দেশও দেন সেনাপ্রধান। শুক্রবার রাতের মধ্যে ওই ব্রিগেডের সব সৈন্যকে ব্যারাকে ফিরতে বলেন। কেন এই হঠাৎ নির্দেশ তার কোনো ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি। এতেই গুঞ্জনের পালে আরও হাওয়া লেগেছে। কারণ পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনাবাহিনী প্রতিবারই ওই ব্রিগেডকে ব্যবহার করেই সরকার পতন ঘটিয়েছে।
তবে সেনাপ্রধানের এতবড় কাণ্ড সত্ত্বেও কোনো প্রকার বিরুদ্ধ মন্তব্য করেননি নয়া পাকিস্তানের কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। উল্টো সেনাপ্রধানের সাফাই গেয়ে বলেছেন, সরকার-সেনাবাহিনী একসঙ্গেই পাকিস্তানের দিন ফেরাবে। খবর ডন, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য নিউজ ও জি নিউজের। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার নিয়ম ভেঙে রাওয়ালপিণ্ডির সেনা সদর দফতরে বুধবার ১৬ থেকে ২০ জনের একটি ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান। সেনাবাহিনীর মুখপাত্রের কাছে ওই বৈঠকের বিষয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈঠকে অংশ নেয়া এক ব্যবসায়ী বলেন, পাকিস্তানের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) ব্যবসায়িক নেতাদের হয়রানি করছে বলে সেনাপ্রধানের সামনে অভিযোগ তুলে ধরেন শিল্পপতিরা।
ভেঙে পড়া অর্থনীতির হাল ধরতে এবং হয়রানি বন্ধে সেনাবাহিনীকে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধও জানান তারা। জবাবে বাজওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন, যারা শিল্পপতিদের অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন। এমনকি ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়লে ব্যবসায়িক নেতাদের সরাসরি তার সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে বলেছেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি জুবায়ের তোফায়েল, আরিফ হাবিব, হুসাইন দাউদ, আলি মোহাম্মদ তবা, আলি জামিল, ইজাজ গহর, সাকিব সিরাজি এবং কয়েকজন টেক্সটাইল শিল্পের ধনকুবের।
কিন্তু রাতের এ বৈঠক সম্পর্কে আগে অবহিত ছিলেন না প্রধানমন্ত্রী ইমরান। পরের দিন বিবৃতি দিয়ে আইএসপিআর জানায়, ‘পাকিস্তানের শীর্ষ শিল্পপতিদের সঙ্গে অর্থনীতি ও নিরাপত্তার পারস্পরিক ক্রিয়া’ শীর্ষক এক বৈঠকে বসেন সেনাপ্রধান বাজওয়া। কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা যায় এবং কিভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো যায়- এসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি।’ ‘অর্থনীতি ও নিরাপত্তা একই সুতোয় গাঁথা’ সুর তুলে সরকারকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে আইএসপিআর। পরদিন বৃহস্পতিবারই শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ইমরান খান। সেখানে তিনিও ব্যবসায়িক নেতাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং এনএবি’র হয়রানি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি সেনা উর্দির ছায়ায় দেশ চালানো ‘পুতুল প্রধানমন্ত্রী’র ভূমিকাও পালন করেছেন নিপুণ কৌশলে। সেনাপ্রধানের বৈঠকের বিষয়ে ইমরান খান বলেন, ‘সেনাবাহিনী ও সরকার একসঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে কাজ করবে।’
পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ ও লেখক ইউসুফ নজর বলেন, দেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে আধিপত্য বিস্তারের বাইরে সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করা ‘বাহানা’ মাত্র। এটি একটি নীরব অভ্যুত্থান। গণতান্ত্রিক সরকারকে পতন ঘটানোর প্রাথমিক স্তর। এদিকে জি নিউজ জানিয়েছে, ইমরান খান কাশ্মীরে ভারতের পদক্ষেপ (৩৭০ প্রত্যাহার) যেভাবে সামলেছেন, তাতে খুশি নন সেনাপ্রধান বাজওয়া। এ কারণে সেনাদের ছুটি বাতিল করে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ইমরান গদি হারাতে পারেন- এ খবর বেশ জলদি চাউর হয়েছে ১১১ ব্রিগেডের ছুটি বাতিল ঘোষণার কারণেই। কেননা এর আগে তিনবার ১১১ ব্রিগেড ব্যবহার করে নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়েছে পাক সেনাবাহিনী। প্রতিবারই রাওয়ালপিণ্ডিতে ওই ব্রিগেড মোতায়েন করা হয়েছিল। এবারও সেখানেই এই ব্রিগেড মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন বাজওয়া।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে ৭২ বছরের অর্ধেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে সেনাবাহিনী। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোট চারবার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটেছে। ১৯৫৮, ১৯৬৯, ১৯৭৭ ও ১৯৯৯ সালে। এর মধ্যে তিনবার সেনাবাহিনীর ১১১ ব্রিগেডকে ব্যবহার করে সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রথমবার ১৯৫৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পদচ্যুত করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। এর ঠিক ২১ বছর পর ১৯৭৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটান সেনাপ্রধান জিয়াউল হক। ১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফের সরকারকে হঠিয়ে দেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অভ্যুত্থান ছিল শুধু ব্যতিক্রম।
ইনিউজ৭১/জিয়া
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।